আমার ওপর ভরসা রাখুন, আমি আপনাদের পাশে আছি
অথবা
বহুদিন পর পর এরকম একেকটা সকাল আসে
বহুদিন পর পর এরকম একেকটা সকাল আসে, যখন নিদ্রিত অলস চোখদুটো খোলা মাত্রই মৃদু আনন্দ-হাওয়া বয়ে যায় কানের পাশ থেকে। চোখদুটো খুলেই অর্ণব প্রথম যেটা দেখতে পায়, সোজাসুজি দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড় করানো তিনপায়া টেবিলের ওপরে রাখা সবুজ পলিথিনের প্যাকেটটা, যেটা সে কিনে এনেছে গতকাল বাড়ি ফেরার পথে। জানলার পর্দার ফাঁক থেকে সূর্যের আলোর একটা সুতীক্ষ্ণ সরু রেখা সরাসরি ছুটে এসে আছড়ে পড়েছে অর্ণবের চোখের ওপর। স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে সে মাথাটা বালিশ থেকে তুলে আলমারির পাশে, দেওয়ালে টাঙানো ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে ন্যায় একবার – ৬টা বেজে ২৫। গত আট বছরের অভ্যেস, শেষ কবে অ্যালার্মের প্রয়োজন পরেছে তার, মনে পরে না। গত আট বছরে বাবা মারা যাওয়ার পরের দিন ছাড়া একদিনও দেরী করে স্কুলে পৌঁছনোর রেকর্ড নেই অর্ণবের। ঠিক সাড়ে ছ’টায় ঘুম থেকে উঠে পরিস্কার হয়ে খবরের কাগজের এপাতা থেকে সেপাতার ফাঁকে ফাঁকে কড়া কালো চা, তারপর বাজার করতে বেরোনো, সংক্ষিপ্ত বাজার সেড়ে, বাড়ি ফিরে স্নান সাড়তেই বেলা পৌঁনে-ন’টা – পনেরো মিনিটে কোনোমতে শার্ট প্যান্ট পরে একটা ভারী প্রাতঃরাশ – ইতিমধ্যেই কবিতা টিফিন কৌটো হাতে হাজির টেবিলের পাশে, জলের বোতল আর টিফিন কৌটো ব্যাগে ঢুকিয়ে চার মাথা মোড়ের বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছে একবার হাত ঘড়িটা দেখে নেওয়াও অর্ণবের নিত্য অভ্যেস – বরাবরই সময় ন’টা পাঁচ থেকে সোয়া ন’টার মধ্যে। মোটামুটি এক ঘন্টা লাগে বাসে করে স্কুলে পৌঁছতে, রাস্তার ওপরেই স্কুল। দশটা চল্লিশের প্রেয়ারে থাকতো অর্ণবের নিত্য হাজিরা। এমনকী একবার কবিতা বিতানকে নিয়ে বাপের বাড়ি গ্যাছে, বাজার-রান্না-টিফিন ইত্যাদির ব্যাপার নেই, অর্ণব তো রবিবারও স্কুলে হাজির ঠিক সাড়ে দশটায় – গেটে তালা দেখে অর্ণব ভুল বুঝে যখন উল্টোদিকের চায়ের দোকানে ঢুকেছে, ফাঁকা দোকানে দোকানদার দিনেশ দা আর অর্ণব হেসে প্রায় লুটিয়ে পরার জোগাড় – সেদিন একটা বিনে পয়সায় স্পেশাল দুধ চা জুটেছিলো তার, বেকারির বিস্কুট দুটো আর একটা নেভিকাট সে নিয়েছিলো পয়সা দিয়েই।
গত কয়েকটা দিনও সে যখন ঠিক উঠে পড়েছে সাড়ে ছ’টায়, তোয়ালে নিয়ে কল ঘরে ঢোকার মুখে যখন মনে পড়ে গ্যাছে, তার আর স্কুল নেই, চাকরি নেই, সন্তানের মতো পরম স্নেহের শ’য়ে শ’য়ে বাচ্চাগুলোর আর ‘স্যার, স্যার’ ডাক নেই, হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলেছে অর্ণব। কিন্তু, আজ তার বড়োই আনন্দের একটা দিন, আজ বরং এতো বছরের নিয়ম ভেঙে আরেকটু ঘুমিয়ে নেবে সে, আজ আর তার কোনো তাড়া নেই। উঠে গিয়ে পর্দাটা ভালো করে টেনে, পাখার রেগুলেটরে এক পয়েন্ট বাড়িয়ে দিয়ে সে আবার শুয়ে পরে বিছানায় – কবিতা গত কাল রাতেই বাপের বাড়ি গ্যাছে বিতানকে রেখে আসতে – কবিতার বাবাই পরামর্শটা দেয়, “বিতানকে এখানে পাঠিয়ে দে, এই সময়টা ওর তোদের কাছে না থাকাই ভালো।” কবিতা সকালেই ফিরে আসবে, তাও, এগারোটা তো বাজবেই, ততক্ষণ ঘুমিয়ে থাকবে অর্ণব আজ, কবিতা এসে কলিংবেল বাজালে তখনই উঠবে। দ্বিতীয় দফায় চোখটা বুঁজলেও ঘুম আসছে না অর্ণবের – এরকম একটা আনন্দের দিন, সে বেলা এগারোটা পর্যন্ত ঘুমিয়ে কাটাবে! অর্ণব আবার উঠে আসে বিছানা থেকে, পর্দাটা এক টানে সরিয়ে দিতেই টুকরো টুকরো আলো ছড়িয়ে পড়ল গোটা ঘরে।
গত সাত দিন কাগজ আসেনি বাড়িতে, কেলো দাকে ডেকে খবরের কাগজ দিতে বারণ করে দিয়েছে কবিতা, এখন প্রতিটা পয়সা বুঝে খরচ করা প্রয়োজন। গত কয়েকটা দিন একবারও বারান্দায় নিজের পছন্দের বেতের চেয়ারটায় বসেনি অর্ণব, বিতান ঘরে আছে বলে নিদেন মিনিট তিনেকের সিগারেট বিরতির আছিলায়ও দাঁড়ায়নি অর্ণব, সবসময় তার মনে হতো সকলে য্যানো তার দিকেই তাকিয়ে আছে, এগিয়ে আসছে আঙুল তুলে, এই বোধহয় কেউ কিছু একটা জিজ্ঞেস করে বসবে অর্ণবকে। কিন্তু আজ আর তার কোনো কুণ্ঠা নেই, কোনোরকম সংশয়, পয়সা গুণে মেপে পা ফ্যালার দায়ও নেই তার – বারান্দায় গিয়ে তার প্রিয় নেভিকাটে আগুন ছুঁইয়ে একটা লম্বা টান দ্যায় অর্ণব, উল্টোদিকের বিলুদের বাড়িয়ে কেলোদা তখন খবরের কাগজ গুঁজছে গ্রিলের ফাঁকে। তৎক্ষণাৎ কেলো দাকে ডেকে একটা টেলিগ্রাফ আর একটা আনন্দবাজার কিনে ন্যায় অর্ণব। সিগারেট শেষে সে তোয়ালে নিয়ে ঢুকে পরে কল ঘরে। কল ঘর থেকে বেরিয়ে একবার সবুজ পলিথিনটা ফাঁক করে দেখে ন্যায় অর্ণব আর সাথে সাথেই তার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে ওঠে। এরপর রান্নাঘরে ঢুকে নিজেই একটু লিকার চা বানিয়ে ন্যায়, কড়া করে, চিনি ছাড়া। চায়ের চিনামাটির কাপ হাতে খবরের কাগজের পাতা ওল্টায় অর্ণব। কুলটিতে ধর্ষণ-মদ্যপ তরুণীর গাড়ির ধাক্কায় মৃত ১, আহত ৩-কসবায় লাঠিচার্জ-মালদা’য় গ্রেফতার-কেকেআরের হার ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। একটু বিরক্তি নিয়েই খবরের কাগজটা ছুঁড়ে সরিয়ে দ্যায় অর্ণব। ইংরাজি কাগজটা নতুন করে খোলার উৎসাহই আর পায় না সে, তাতেও কী কী খবর আছে, বা থাকতে পারে, তা সবই প্রায় তার জানা। বরং, আজ এই আলো ঝলমলে দিনটা একটু কবিতার মতো বাহুল্যতার সাথেই করেই শুরু করা যাক – চায়ের কাপ হাতে সে বইয়ের তাক থেকে নামিয়ে আনে ‘শেক্সপিয়ার’স সনেট’ আর মাঝখান থেকে একটা যেকোনো পাতা খুলে চায়ের কাপে একটা চুমুক ফেলে চিৎকার করে পড়তে শুরু করে, “শ্যাল আই কমপেয়ার দি টু আ সামার ডে…”।
আজ আর কোনো দ্বিধা নেই অর্ণবের – সে পায়ে জুতো গলিয়ে বাজারের ব্যাগ হাতে সোজা বেরিয়ে আসে বাড়ি থেকে। কবিতা এখনও ফেরেনি, বাজার থেকে কী কী আনবে তা তার থেকে জেনে নেওয়ার প্রয়োজনও নেই অর্ণবের, আনাজ প্রায় কিছুই নেই বাড়িতে। হাঁটতে গিয়ে হাঁটুর কাছটা একটু ব্যাথা করে উঠছে – গতকাল বিক্ষোভ সমাবেশে পুলিশ প্রবল লাঠিচার্জ করে, পরপর তিনটে লাঠি এসে থামে বাঁ পায়ের হাঁটুর ঠিক নীচে – গতকালের তুলনায় ফোলাটা একটু কমলেও ব্যাথাটা বেড়েছে – তবুও কুছ পরওয়া নেহি, এমন একটা ভাসান-ভাসান দিনে ওসব কেয়ার করলে চলে না। পালং শাক, ফুলকপি, ব্রকওলি, গাজর, ধনে পাতা, বেল পেপার এসব ব্যাগে পুড়তে পুড়তে ক্রমশ এগিয়ে আসতে আসতে ভুলোর দোকানের সামনে এসে দাঁড়ায় অর্ণব – একটা কচি পাঁঠা ঝুলছে ওপর থেকে, টপ টপ করে গড়িয়ে পরছে রক্ত, টাটকা – “এককেজি দে দেখি রাং থেকে”। অর্ণব যখন বাড়ি ফেরে, সদর দরজা খোলা, তার মনে পরে ডুপ্লিকেট চাবি থাকে কবিতার কাছে। রান্নাঘরের মেঝেতে বাজারের থলে দুটো রেখে হাত ধুয়ে ঘরে ঢুকতেই অর্ণব দ্যাখে, কবিতা বিছানার চাদর বদলাচ্ছে – ঘাতক বেড়ালের মতো পা টিপে এগিয়ে গিয়ে কবিতাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে অর্ণব। এরকম একটা ফুল-ফুল দিনে বয়স য্যানো অনেকটাই কমে গ্যাছে ওদের।
গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত, পোস্ত বাটা, পালং শাক, লাল করে কষা পাঁঠার মাংস। দেখেই মনটা ভরাট হয়ে আসে অর্ণবের। পোস্ত বাটা দিয়ে একগাল ভাত মুখে দিয়েই পরের গালটা সে মাখে একটু মাংস একটু আলু আর একটু চর্বি দিয়ে। আহা, কতদিন পর ভাত খেয়ে এরকম আনন্দ হচ্ছে তার। “কেমন হয়েছে? মা’য়ের মতো পেরেছি?” কবিতার কথায় মুখ তুলে মৃদু হাসে অর্ণব আর একটু বেশি করে মাংস দিয়ে ভাত মেখে হাত এগিয়ে দেয় অর্ণব কবিতার দিকে। ভাতটা চিবিয়ে নিয়ে কবিতা উঠে রান্নাঘর থেকে আরেকটা বাটি নিয়ে আসে – শেষ পাতে টমেটোর চাটনিও আছে আজ।
এমাসের বাড়ির ইএমআই দেওয়া হয়নি, গতকাল ছিলো শেষ দিন – কবিতার ফোনে এসএমএস ঢোকে। কবিতা একবার এসএমএসটা খুলেই ডিলিট করে দ্যায় তৎক্ষণাৎ। “আমরা যোগ্য” নামের যে হোয়াট্স্অ্যাপ গ্রুপ, তাতে পরের পর মেসেজ ঢুকছে অবিরাম – ফোনও আসছে থেকে থেকেই। অর্ণব ফোনটা মিউট করে রেখেছে সকাল থেকেই, হোয়াট্স্অ্যাপটাই ডিলিট করে দ্যায় অর্ণব মোবাইল থেকে – এরকম মটন-মটন দিনে অর্ণব এসব হ্যাজ আর বইবে না কিছুতেই, কেবলই আনন্দে থাকবে, আলোয় থাকবে, বসন্তে থাকবে অর্ণব আজ গোটা দিন।
কবিতারও খাওয়া শেষ হলেই অর্ণব মোবাইলটা হাতে তুলে ন্যায়, আজ দুপুরে বিছানায় পরে থাকার দিন নয়। একটা অ্যাপ থেকে সে বিকেল সাড়ে চারটের একটা সিনেমার টিকিট কাটে, মাল্টিপ্লেক্সে, সবচেয়ে দামি সাড়ে পাঁচশো টাকার দুটো টিকিট – ইদানিং এক বৃদ্ধ দম্পতির শেষ রাত বিষয়ক একটা দারুণ ছবি চলছে শহরে। কবিতাকে জানাতেই সে বলে, “এখনই তো তিনটে পনেরো, একটা বাস আর তারপর একটা অটো – পৌঁছতেই তো পারবো না সময়ে।” অর্ণব মুচকি হেসে বলে, “উবের ডাকছি, তুমি রেডি হও জলদি।” কবিতা ওর সবচেয়ে দামি শাড়িটা পরছে আজ, অর্ণব হলুদ পাঞ্জাবী। কবিতা আজ সবচেয়ে কম সময় নিয়েছে তৈরি হতে, তবুও তার তৈরি হওয়ার আগেই বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে ডিলাক্স এসি ক্যাব – অর্ণব বেড়িয়ে জানায়, “অ্যাপে তিনশো একুশ টাকা দ্যাখাচ্ছে, একটু দাঁড়াতে হবে দাদা, দু’শো টাকা এক্সট্রা দেবো”। ক্যাবে উঠে থেকে নামা পর্যন্ত গোটা রাস্তাটা জুড়েই অর্ণবের ডান হাতটা ছিলো কবিতার কাঁধে।
মাল্টিপ্লেক্সে নামার পর মাত্র মিনিট দশেকই আছে হাতে – তার মধ্যেই অর্ণব ছুটে গিয়ে একগোছা জারবেরা কিনে হাঁটু গেড়ে বসে পরে কবিতার সামনে, মাঝরাস্তায় – কবিতার লাজুক হাসি য্যানো অর্ণবের চারপাশের বিকেল-বিকেল পৃথিবীটাকে আরো অনেকটা লাল করে দিলো এক মুহূর্তেই। হলে ঢোকার আগে অর্ণব একটা বড়ো চিজ্ পপকর্ন আর দুটো কোল্ড ড্রিংস কিনে ন্যায়, পেট তখনও ভর্তি থাকা সত্ত্বেও – সিনেমা দেখতে দেখতে যতোটা পারবে ওরা খাবে, বাকিটা ফেলে আসবে চেয়ারের নীচে – পৃথিবীতে তো কতোকিছুই আছে, কতোকিছুই তো ঘটে, যা কেবলই অপচয়ের – ঠিক য্যামন হাজার হাজার ছেলেমেয়ে গুলোকে সামাজিকভাবে বাতিল করে দেওয়া হলো রাতারাতি, অর্ণবকে, ওর হাজার হাজার সহকর্মীকে, সহযোদ্ধাকে স্রেফ বাড়তি পপকর্নের মতো কুঁড়াদানে ছুঁড়ে ফেলে দিলো একটা ব্যর্থ প্রশাসন – নাহ্, এসব আজ আর ভাববে না অর্ণব, বরং সিনেমা হলের সবচেয়ে দামি সুপ্রিম সোফায় বসে আরামের একটা চুমু খেয়ে ফ্যালে সে কবিতার গালে আর হাত রাখে কোমড়ের কাছে। সিনেমার আগে জাতীয় সঙ্গীত শুরু হলে উঠে দাঁড়াতে বেমালুম ভুলে যায় আজ অর্ণব আর কবিতা। সিনেমা শুরু হলে হল অন্ধকার হয় আর অর্ণবের হাত উঠে আসে কবিতার কোমড় থেকে বুকের ওপর – এরকম পপকর্নসুলভ দিনে অর্ণবের হাত সরিয়ে দেওয়ার বদলে কবিতা শাড়িটাকে মৃদু টেনে ঢেকে দ্যায় অর্ণবের হাত আর নিজের হাত রাখে অর্ণবের থাইয়ে।
শেষ দৃশ্যে চোখে জল চলে আসে অর্ণবের, কবিতারও – শেষ ক’টা দিন কতোবার থেকে থেকে কেঁদে উঠেছে ওরা, কখনো সশব্দে, কখনো নিরব নিঃশব্দ জলের ধারা গড়িয়ে নেমেছে নাকের পাশ থেকে – কতো কতোদিন পর ওরা কেঁদে ফেলেছে কেবল একটা সিনেমা দেখে – দুজন দুজনকে চোখের জল মুছতে দেখে ফ্যাক্ করে হেসে ফ্যালে দুজনেই।
সিনেমা থেকে বেরিয়ে অর্ণব আর কবিতা একটা টোটো ধরে চলে আসে খালপাড়ের সাঁকোটার কাছে – এখানে এখন আলো লেগেছে, কয়েকটা বেঞ্চ বসেছে পরপর – আগে ছিলো না, যখন অর্ণব আর কবিতা প্রেম করতে আসতো এখানে। নতুন আলো বসেছে, বেঞ্চ বসেছে সাড় দিয়ে – তবুও ওরা আলোর নীচে নীল-সাদা বেঞ্চগুলোয় বসবে না আজ, সাঁকোর নীচে স্যাঁতস্যাঁতে মাটিতেই বসবে – এসব বাহ্যিক ঝলমলানি ঠেলে এই ব্যবস্থাটার ভেতরের পচে যাওয়া ফুসফুস, বিকল যকৃৎ, গলে গলে পরতে থাকা হৃৎপিণ্ড দেখে ফেলেছে ওরা বিগত কয়েকটা দিনেই। যাক্, আজ এমন একটা জোয়ার-জোয়ার দিনে এসব আর ভাববে না ওরা – মাটিতে ধপ্ করে বসে পরে অর্ণব আর কবিতা – ছেলেব্যালায় ওরা যখন আসতো এখানে, একটা খবরের কাগজ থাকতো সাথে পেতে বসার জন্য, আজ নেই – কোই বাত নেহি – আজ ওদের জামাকাপড় খারাপ হয়ে যাওয়ারও কোনো আশঙ্কা নেই, নেই নেই, সংশয় নেই, দ্বিধা নেই, দ্বন্দ নেই, এবং, ভয় নেই।
অনেকক্ষণ সময় কাটিয়ে অর্ণব ঠিক করে ওরা রাতে বাইরে খেয়ে বাড়িতে ফিরবে। কবিতা মৃদু আপত্তি জানায়, “সকালের অনেকটা মটন রয়ে গ্যাছে। ছ’টা রুমালি রুটি কিনে নিলেই হবে।” “থাক। আজ আর এক খাবার দুবার নয়। আমিনিয়া চলো। মটন বিরিয়ানি আর চিকেন চাঁপ।” ওদের অঞ্চলে একটাই আমিনিয়া। একটু হেঁটে একটা অটো, তারপর আবার একটু হাঁটা। তবু আজ তেঁতুলতলা মোড় থেকে একটা হলুদ ট্যাক্সি ডেকে ন্যায় অর্ণব। “সুপার মার্কেট, পোস্ট অফিসের সামনে, আমিনিয়া। কতো নেবে?” “আড়াইশো টাকা।” এইটুকু রাস্তা দেড়শো টাকার বেশি নেওয়ার কথা নয়, তবু আজ দরদাম করে না অর্ণব – এরকম রেজালা-রেজালা দিনে দরদাম চলে না। “অনলাইন নাও?” “না, ওসব নেই।” “পাঁচশো টাকার নোট। খুচরো হবে?” পকেট হাতড়ে ট্যাক্সিওয়ালা যে টাকার বান্ডিলটা বের করে, তাতে একটা একশো একটা পঞ্চাশ দুটো কুড়ি, বাকী সব পাঁচশো। “একশো নব্বই টাকা আছে।” “তাতেই হবে।” অর্ণব আর কবিতা উঠে পরে ট্যাক্সির ভেতর আর অর্ণব ফস করে ধরিয়ে ন্যায় একটা নেভিকাট – কবিতা সিগারেট খায় না, ঘুরতে গেলে অর্ণব জোর করলে এস্ নামের একটা সরু সিগারেট খায় শুধু, যেটা অর্ণবের বিচারে সিগারেটের মর্জাদা পায় নি – নিজের সিগারেট কিনতে গিয়ে একটা এস্ও কিনেছে অর্ণব – পকেট থেকে বার করে কবিতার দিকে এগিয়ে দিতেই সে অন্যসময়ের সময় মতো আপত্তি করে না আজ, গুঁজে ন্যায় ঠোঁটের ফাঁকে আর অর্ণব ধরিয়ে দ্যায় একটা দেশলাই। বিরিয়ানি আর চাঁপের পর দুটো ফিরনিও চেয়ে ন্যায় অর্ণব। কার্ডে বিল দেওয়ার পর, বলা বাহুল্য, ট্যাক্সিওয়ালার থেকে পাওয়া পুরো খুচরোটাই অর্ণব গুঁজে আসে বিলের ভেতর, বকশিস বাবদ। এরপর আমিনিয়া থেকে বেরিয়ে অনলাইনে একটা এসি ক্যাব ডেকে ন্যায় অর্ণব। ক্যাব আসতে চোদ্দ মিনিট লাগবে, সামনে চোখ ফেলতেই সুপার মার্কেটের একতলায় একটা অন্তর্বাসের দোকান দ্যাখে অর্ণব – কতোবারই কোথাও এরকম দোকানে পাতলা ফিনফিনে অন্তর্বাসের সেট দেখলেই অর্ণব কবিতাকে দেখিয়ে, খানিক মজা করেই, জিজ্ঞাসা করতো, “পরবি এগুলো?” বরাবরই উত্তরে কবিতা বলতো, “এগুলো পরার থেকে তো না পরাই ভালো। পয়সা দিয়ে কিনে কারা পরে এগুলো?” যথারীতি কোনোবারই কেনা হয় না। ক্যাব আসছে, এখনো এগারো মিনিট – অর্ণব কবিতার হাত ধরে, প্রায় হিড়হিড় করে টানতে টানতেই নিয়ে ঢোকে দোকানের ভেতর – ফাঁকা দোকানের একমাত্র মহিলা কর্মি তখন অলস মনে মোবাইল ঘাঁটতে ঘাঁটতে চিউইংগাম চিবোচ্ছে। “সবচেয়ে দামি আর সবচেয়ে অ্যাপিলিং সেটটা দিন তো, ওর মাপে।” লজ্জায় হাত দিয়ে মুখ আড়াল করে কবিতা, তারপর সরিয়েও ন্যায় – প্রথম সেটটা বাতিল করে সেই, “না না গোলাপী নয়, গোলাপী আমাদের কারোরই পছন্দ নয়। ব্লাড রেড অথবা কালোর ওপর দেখান।” তারপর কবিতা আর অর্ণব দুজনেই হাসে দুজনের দিকে চেয়ে।
বাড়ি ফিরে শোবার ঘরে ঢুকে লঞ্জেরির সেটটা বিছানায় রেখে কবিতা আগে ছোটে কলঘরের দিকে – সকাল থেকে যা খাওয়া দাওয়া চলছে, তাতে বাড়ি ফিরতে আরেকটু দেরী হলেই কেলেঙ্কারি হয়ে যেত। কবিতা কলঘর থেকে বেরোতেই দ্যাখে অর্ণব সবুজ পলিথিনটা হাতে নিয়ে চেয়ে আছে ওটার দিকে। অর্ণব চোখ তুলে কবিতার দিকে তাকায় – বেশ খানিকটা সময়ধরে ওরা দুজনে কেবল চেয়ে থাকে দুজনের দিকে – বড়োই সরাসরি এই চেয়ে থাকা, নিরেট, ঘন। এরপর অর্ণব মুখে মৃদু হাসি আনলে কবিতাও হাসে – ভীষণরকমের একটা বিষণ্ণতা ছড়িয়ে ছটিয়ে থাকে এই আলতো হাসির ভেতর – য্যানো বহু বহুদূরে একটা নদী বয়ে চলেছে প্রবল বেগে আর বহুদূর থেকে, একটা গোটা জঙ্গল পেরিয়ে সেই বহতার শব্দস্রোত ছুটে এসে থামছে তোমারই নাগালে, কিছুটা করুণা নিয়ে। এরপর কবিতা অর্ণবের হাত থেকে প্লাস্টিকটা ছিনিয়ে নিতে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলে অর্ণবও উঠে আসে কলঘরের দিকে। কবিতা ফ্রিজ থেকে বের করে আনা আপেলের জুস ঢালে দুটো কাঁচের গ্লাসে আর সবুজ প্লাস্টিকটা থেকে বের করে একটা কালো কাঁচের শিশি। ছুরি দিয়ে শিশিটার ঢাকা কেটে তার ভেতর থেকে সদা পাউডার সে সমপরিমাণে ঢালে গ্লাস দুটোয় আর মিশিয়ে নিতে থাকে ভালো ভাবে চামচের টুংটাং শব্দের সাথে। বেশ কিছুটা সময় পার করে হাফ প্যান্ট পরে অর্ণব কলঘর থেকে বেরিয়ে দ্যাখে, কবিতা তাদের সদ্য কিনে আনা লঞ্জেরিটা পরে হাতে দুটো কাঁচের গ্লাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিছানার পাশে। বহুদিন কবিতার শরীরের ভালোভাবে নাগাল পায়নি অর্ণব – দিন চারেক আগে অর্ণবের মন কিছুটা ঘটমান ঘটনাপরম্পরার থেকে সরিয়ে আনতে চেয়ে কবিতা জোর করলে, দীর্ঘক্ষণ চেষ্টা করেও অর্ণব ইরেকশনে পৌঁছতে পারেনি, সম্ভবও নয় এই বিপুল মানসিক চাপ মাথায় নিয়ে। কিন্তু আজ তো ওদের পরিত্রাণের দিন, এরকম একটা পালক-পালক দিনে সদ্য কেনা অন্তর্বাসে কবিতাকে দেখেই অর্ণব বুঝতে পারে, ওটা ভয়ানয় শক্ত হয়ে উঠেছে, যেরকম হয়নি বহু বহু দিন, হয়তো মাস, কিমবা বহু বছর। কবিতাকে দুটো গ্লাস হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অর্ণবের বিয়ের কথা মনে পরে যায় – হিন্দি সিরিয়ালের অনুকরণে ফুলশয্যার রাতে কবিতার হাতে একটা দুধের গ্লাস ধরিয়ে দ্যায় ওর বাড়ির লোকেরা, ঠিক এভাবেই কবিতা একটা গ্লাস হাতে ঢুকে আসে ঘরে, আর তারপর ভাগাভাগি করে নেওয়া একটা দুধের গ্লাস, একটা রাত, একটা সন্তান, একটা বাড়ি, এতগুলো বছর, একটা জীবন। অর্ণব হেসে ফ্যালে আর এগিয়ে গিয়ে একটা গ্লাস নিজের হাতে তুলে ন্যায় কবিতার থেকে – এক নিঃশ্বাসে দুজনেই শেষ করে ফ্যালে নিজেদের গ্লাস। গ্লাসদুটো রেখে এসে অর্ণব সকালের খবরের কাগজটা তুলে এনে প্রথম পাতায় বড়ো করে ছাপা মাইক হাতে মুখ্যমন্ত্রীর ছবিটা কাঁচি দিয়ে কেটে সেলোটেপ দিয়ে আটকে দ্যায় ওদের শোবার ঘরের দেওয়ালে – মুখ্যমন্ত্রী মাইক হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছেন একটা সভার মঞ্চে আর তার নীচে বড়ো হরফে লেখা, “আমার ওপর ভরসা রাখুন, আমি আপনাদের পাশে আছি।” এরপর অর্ণব ঘরের আলোটা নিভিয়ে দেয়। অন্ধকারের অ্যাতো স্নিগ্ধতা ওরা এর আগে, এইভাবে অনুভব করেনি কখনো। অর্ণব বিছানায় শুয়ে জড়িয়ে ধরে কবিতাকে, আর কবিতাও, আরো শক্ত করে। বলা বাহুল্য, ওদের কেনা নতুন লঞ্জেরিটা মিনিট কুড়ির বেশি গায়ে রাখতে পারেনি কবিতা।
দেবরূপ সরকার
জন্ম ও বেড়ে ওঠা কোলকাতা ও বরানগরে। ফাল্গুনী রায়, শৈলেশ্বর ঘোষ, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, এমনকী রামকৃষ্ণেরও এককালে হেঁটে চলে বেড়ানো এলাকায় থাকেন বলে ভয়ঙ্কর আত্মশ্লাঘায় ভোগেন। চূড়ান্ত বাচাল, অধৈর্য। আজন্ম ত্যাঁদড়। পড়াশোনা উদ্ভিদবিদ্যা নিয়ে। গবেষণার সাথে যুক্ত। ‘হপ্তাক কাচরা’ নামক একটি পত্রিকার কর্মী। কোনো লেখারই প্রকৃত অনুবাদ সম্ভব নয়, এমনটাই বিশ্বাস করেন, অথচ, রিচার্ড ব্রটিগান, ত্রিস্তঁ জারা, কার্ট কোবেন, বুকাওস্কি প্রমুখদের বিভিন্ন লেখার অনুবাদ করেছেন। একেবারেই কবিতা লিখতে পারেন না। মাঝেমধ্যে কিছু মধ্যমেধার গল্প লেখেন। লেখালিখি করেন মূলত পাঠিকাদের সাথে আলাপের লোভে এবং সাঁতারে তিনি একেবারেই পারদর্শী নন বলে। ভগবানের পেচ্ছাপ, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ময়দানে বসে বিয়ার খেতে খেতে যা যা বলবো তোমাকে, একটি বই – ইত্যাদি কিছু অপাঠ্য পুস্তক ও পুস্তিকা লিখেছেন, যেগুলো আলাদা করে কিনতে লাগেনা, লেখকের সাথে একটু হেসে একটা সিগারেট খেলে লেখক নিজেই সেটা লিখে দেন। পাহাড়ে ঘুরতে ভালোবাসেন। প্রতিদিন স্বপ্নে গোচেলা বা অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্পের মাথায় উঠে বসে থাকেন, কিন্তু বাস্তবে ৩৬০০ মিটারের বেশি উঁচুতে ওঠা হয়নি। ছবি তোলেন কেবল মোবাইল ফোনে একটা ভালো ক্যামেরা আছে বলেই। মদ খেতে ভালোবাসেন। তামাক সহ্য হয় না। চূড়ান্ত মিথ্যেবাদী। প্রবল ভীতু। ইদানিং আবার হাইপারটেনশন, উচ্চ কোলেস্টেরল ও স্পন্ডালাইটিসে ভুগছেন।