thaba.in

রাজার্ষি চট্টোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার​

শেয়ার করুন

সৌপ্তিকঃ নব্বইয়ের গোড়া থেকে ২০২৫, আজ পঁয়ত্রিশ বছর তুমি কবিতা লিখছ। সেই ‘নাবিক জন্মের ভবিষ্য’, ১৯৯৮ থেকে ‘প্রিয় কার্ডিগান’, ২০২১। কী ভাবে দেখ এই সুদীর্ঘ যাত্রাপথ? কীভাবে চিহ্নিত করো তোমার কবিতার বিভিন্ন বাঁকবদল?  

রাজর্ষিঃ বাঙালি প্রায় স্বভাবগতই কবিতা লেখেন। কিন্তু প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই একদম প্রথম লেখাটার একটা প্রাথমিক পরিবেশ থাকে। যদি না সেই কোন বইমেলায় আমি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘বাঘ ডেকেছিল’ কবিতার বইটি চুরি করতাম, তাতে ‘সুভাষদার বইতে আমি সই করব বলে’ একরাশ বিস্ময় নিয়ে মৃণাল সেন সই করতেন, আর আমি সেই রাতেই বাড়ি এসে লিখে ফেলতাম, ‘এখনো শেয়ালেরা এ পাড়ায় ও পাড়ায় / রাজারানী সেজে বসে বাঘের গন্ধ পায়…’ ইত্যাদি; তাহলে মনে হয় আমার আর কবিতা লেখার কোন কারণ থাকতো না। প্রায় একটা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্ম, প্রাথমিকে সারদা মিশন তারপর বুনিয়াদিতে হিন্দু – এই স্কুলিং নিঃসন্দেহে আমাকে একটা এক্সপোজার দিয়েছিল। বাহুল্য বলা, প্রেম আর পতাকা আমার যেন লেখার পূর্ব নির্ধারিত বিষয়ই ছিল। তারপর তো আরো কিছুটা হেঁটে ‘নাবিক জন্মের ভবিষ্য’। 

দেখ, জীবনের বাঁক বদলের মতোই কবিতার বাঁক বদল। দেখা আর শোনাগুলো দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। জানলাও খুলে যাচ্ছে একের পর এক। প্রচুর আলো ঢুকছে। একটা নির্দিষ্ট জীবনযাপন তুই বেছে নিচ্ছিস, যেটা সামাজিক ন্যায়-নীতির ক্ষেত্রে সাধারণ বা স্বাভাবিক নয়, বহু মানুষের বৃত্ত তুই অতিক্রম করে যাচ্ছিস, তোর বৃত্ত অতিক্রম করা যাচ্ছে বহু মানুষ। এই দেওয়া-নেওয়া পর্বগুলোতেই বাঁকে বাঁকে এক একটা করে শুরুয়াৎ অপেক্ষা করে থাকে। এর সঙ্গে তোর জীবন দর্শন সমাজনীতি রাজনীতি এরাও অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তোর বৃত্তিও। তোর পাঠ ও গঠন। 

একসময় খুব জোর গলায় বলতাম, কবিতা কোন পারফর্মিং আর্ট নয়। কিন্তু এখন মনে হয়, sole performance of a human soul. দল সংঘ কাল্ট ম্যানিফেস্টো – এদের কারো সঙ্গেই কবিতার বিন্দুমাত্র কোন সম্পর্ক নেই। প্রত্যেকের প্রকাশের একটা মাধ্যম থাকা উচিত বলে আমার মনে হয়। একটা নির্দিষ্ট ভাষা ও তার শৈলী। আমার ক্ষেত্রে মনে হয় এটা কবিতারই ভাষা। এটাই আমার একমাত্র প্রকাশ মাধ্যম। এই ভাষাটা সময়ের সাথে সাথে আবিষ্কৃত হয়। এটাইতো বাস্তবিক যে বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থের ভাষা সময়ের সাথে সাথে বিভিন্ন হবে। তবে, আমি এখন ভাষার সারল্যে আস্থা রাখি। যদিও, চিন্তা ও ভাবনার বিভিন্ন স্তর ক্রমশই জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠেছে।

সৌপ্তিকঃ কবিতা সম্পূর্ণ এক ব্যক্তিগত প্রয়াস, এক ব্যক্তিগত প্রকাশ। আলাদা করে গোষ্ঠী, পাঠচক্র, ওয়ার্কশপ, ক্যাম্প ইত্যাদি কি আদৌ গুরুত্বপূর্ণ? মানে এসব কি কবিকে কোনোভাবে সাহায্য করে তার কবিতা নির্মাণে?  

রাজর্ষিঃ তোর জীবন যাপন যতদূর সামাজিক ততদূর আদান-প্রদানের সম্পর্কটা প্রতিষ্ঠিত হয়। আমাদের সময়ে কবি লেখক সমাজে একটা চিন্তাভাবনার আদান প্রদানের সুস্থ সহজ পরিবেশ ছিল। তবে এখানে কবি লেখক সমাজ বলতে আমি সুনির্দিষ্ট কিছু মানুষের কথা বলছি যারা কোন অর্থেই ‘বাংলা সাহিত্যের মূল স্রোত’-র সঙ্গে ছিলেন না। জল জঙ্গল পাহাড় আমরা ঘুরে বেড়াতাম। একটা সাময়িক উত্তেজনা, বা, আবেশ, আবেগ, প্রেরণা নিঃসন্দেহে কাজ করত। লেখাকে কমবেশি আক্রান্তও করতো কিন্তু আমার ক্ষেত্রে কোন কিছুই দীর্ঘ বা চিরস্থায়ী হয়নি। কারন আমার অকারণ কৌতুহল ও ঔৎসুক্য। আমার কাছে যত প্রশ্ন ছিল তার উত্তরমালা তত ছিল না। ক্রমশই আমি একা হয়েছি। এসবের আয়োজন ও প্রয়োজন ফুরিয়েছে। কবিতা খেলা মেলার বিষয় নয়। দলগত চর্চা বা চর্যা নয়। সুতরাং, একান্ত নিজের সঙ্গে নিজের যে কথোপকথন সেটাই জরুরী। গোষ্ঠী, পাঠচক্র, ক্যাম্প, কাল্ট–এ সবই ম্যানিফেস্টো তৈরি করে; যা ক্ষতিকারক। ঠিক সে রকমই ওয়ার্কশপ। কবিতার রাজ্যে কোন ব্যক্তি অভিভাবকত্ব চলে না। নিজের জীবনযাপন ও পাঠ-পঠনই শেষ কথা।

সৌপ্তিকঃ তোমার সমসাময়িক কবিদের সিংহভাগই যেখানে সনাতন কবিতা নির্মাণকে, অর্থাৎ ছন্দ-মাত্রা-অন্ত্যমিল ইত্যাদিকে কমবেশি প্রাধান্য দিয়েছে, সেখানে তুমি সেগুলোর তোয়াক্কা না করে বরং এক নিজস্ব ভাষা ও শৈলী নির্মাণে মনোনিবেশ করেছ। ‘নাবিক জন্মের ভবিষ্য’ থেকেই তোমার কবিতায় এটা লক্ষ করা যায়। এটা কি একদম প্রথম থেকেই করা? না, লিখতে লিখতে কোনো এক বিশেষ সময় এসে তুমি এই অগতানুগতিক রাস্তা বেছে নিয়েছিলে?

রাজর্ষিঃ এ কথা বহুবার বলা, আমরা ছড়া পদ্য এবং কবিতার শ্রেণীভাগ করতে জানিনা। ছন্দ-মাত্রা-অন্ত্যমিল সো-কলড বাংলা ‘কবিতা’র প্রভুত্বকারী শক্তি। কবিতার বিশ্বীয় অবস্থানের সঙ্গে যা পরিপন্থী। 

এই ধারণা আমার প্রথম থেকেই। 

দেখ, তোর যদি কারো কাছে কোন দায় না থাকে, তাহলে তুই স্বেচ্ছাচারী। নাশকতার দেবদূত কবিদের রাজ্যে এই স্বেচ্ছাচারটাই স্বাভাবিক। যে জানে সে জানে। যে মানে সে মানে।

সৌপ্তিকঃ কবিতার পাশাপাশি তুমি প্রচুর গদ্য লিখেছ। তোমার গদ্য-গল্প সংগ্রহ – ১ খুললেই দেখা যাবে আশির ওপর গদ্য-গল্প সংকলিত হয়েছে তাতে। এছাড়াও, আছে ঋতবীণা, উপন্যাস। গদ্য রচনা একটা একদমই আলাদা প্রয়াস যার সাথে কবিতা লেখার কোনো সম্পর্ক নেই। দুটো পুরোপুরি আলাদা মাধ্যম ও প্রকশভঙ্গি। তুমি কি এটা বিশ্বাস করো? নাকি, তোমার কাছে এরা একে অপরের পরিপূরক কিংবা এরা একে অপরকে কোনো ভাবে প্রভাবিত করে?

রাজর্ষিঃ নিঃসন্দেহে গদ্য রচনা কবিতা রচনার ক্ষেত্র থেকে একটি পৃথক প্রয়াস। কিন্তু একই ব্যক্তির উৎস ভাবনায় ভাষা সমাহার একে অপরের পরিপূরক হয়ে ওঠে। এটা আমার নিজস্ব একটা পাঠ। 

সৌপ্তিকঃ তোমার অনেক লেখা পড়েই আমার মনে হয়েছে যে লেখাগুলোয় তুমি ছোট গল্প ও মুক্ত গদ্য এই দুটো ফর্মকে মিলিয়ে দিতে চেয়েছ, তা পত্র-পত্রিকায় সেগুলো যে বিভাগেই প্রকাশিত হয়ে থাক না কেন। এটা কেন করা? আবার ধরো, তোমার গদ্য-গল্প সংগ্রহে তুমি গদ্য এবং গল্প বলে আলাদা বিভাগ রাখোনি। এই বিভাজনটা কি সচেতনভাবেই এড়িয়ে যেতে চেয়েছ বারবার? পাঠকের মূল্যায়নের ওপর ছেড়ে দিতে চেয়েছ?

রাজর্ষিঃ আমার কাছে কনটেন্ট বেশি গুরুত্বপূর্ণ।  আঙ্গিক তার বহিরঙ্গে। আমার গল্প কখনো কোনভাবেই নিটোল গোল গল্প নয়। এটা পরীক্ষিত ও নিরীক্ষিত উভয়তই সত্য। আমার যে কোন একটা লেখাকে শুধু গল্প বা শুধু মুক্ত গদ্য  বলে চিহ্নিত করা যায় না। ঋতবীণার মেটান্যারেটিভ নিয়ে মলয় রায় চৌধুরী বিস্তৃত লিখেছিলেন। গদ্য গল্প সংগ্রহের বিভাজনটা সচেতন ভাবেই রাখিনি। কতিপয় পাঠক। তারা যেভাবে পড়ে আনন্দ পাবেন। 

সৌপ্তিকঃ লেখক-কবির একটা রাজনৈতিক সচেতনতা বা মূল্যবোধ থাকা জরুরি; তবে আজকের বাস্তবতায় সেটা কি একমাত্র ব্যাক্তিগত এক বোধের জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে? তোমার কী মনে হয়?

রাজর্ষিঃ  প্রেম আর পতাকার কথা আগে বলছিলাম। এই দুটোরই ধ্যান এবং ধারণা সময়ের সাথে সাথে বদলাতে থাকবে। আমি তোর সাথে একমত, কবি বা লেখক তার যদি কোন রাজনৈতিক সচেতনতা না থাকে তাহলে তার লেখাকে সন্দেহ করা উচিত। কিন্তু আজ আর কোন সংঘ নেই। একান্ত ব্যক্তিগত বোধই ক্রমশ সংহত হতে থাকে।

সৌপ্তিকঃ আজীবন লেখালিখি, স্বাধীন জীবিকা, সম্পর্ক থেকে সম্পর্কে বারবার, চূড়ান্ত শহুরে বেঁচে থাকা আবার শহর থেকে দূরে বাঁকুড়ার নিভৃত আশ্রয়ে কোলাহলবিমুখ জীবনযাপন, সব মিলিয়ে তোমার সত্তাটাকে, ব্যক্তি রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায়কে, তুমি আজ কীভাবে ডিফাইন করো?  

রাজর্ষিঃ Life is wonderful, once you know how to live it. এটা শুধু আপ্ত বাক্য নয়। এটা আমার জীবন বোধ ও বিশ্বাস। তুই তোর অনেক ছোটবেলা থেকে আমাকে দেখছিস। তখনও সেটা আমার খুব বড় বেলা নয়।  

শেষ পর্যন্ত তোর দুটো আশ্রয় হতে পারে এক চরৈবেতি ও দুই মাধুকরী। আমি সেদিকেই যেতে চাই। মূল জায়গাটা হল নাশকতা ও স্বেচ্ছাচার। 

দেখ, নিজেকে হিউমিলিয়েট করতে জানতে হবে। এবং সেটাই শেষ পর্যন্ত নেগেট করবে। It would be a journey from humiliation to negation. A total negation.

Poppy Field and Scarlet Flowers, আমার ইংরেজি এন্থলজিতে আমি লিখেছিলাম 

I might tell you someday 
I was never born
Never physical engineered
I was rather a mystery 
Died out of death

এটাই যেন সত্যি প্রমাণিত হয়।

রাজার্ষি চট্টোপাধ্যায়

জন্ম: ৭ই মে, ১৯৭০। স্থান: বরানগর, কলকাতা। প্রকাশিত গ্রন্থ: নাবিক জন্মের ভবিষ্য (কাব্যগ্রন্থ, ১৯৯৮), জগৎকারুসভা (কাব্যগ্রন্থ, ২০০৫), পিগিকলোনি (কাব্যগ্রন্থ, ২০১০), কথাপুরুষম (কাব্যগ্রন্থ, ২০১৬), প্রিয় কার্ডিগান (কাব্যগ্রন্থ, ২০২১), রমলাকান্তের উট (গদ্যগ্রন্থ, ২০০৭), রমলাকান্তের উট ও অন্যান্য (গদ্যগ্রন্থ, ২০১২), গদ্য গল্প সংগ্রহ -১ (২০২১), ঋতবীণা (উপন্যাস, ২০১৪) এবং Poppy Field and Scarlet Flowers (English Anthology, 2018)। সম্পাদিত পত্রিকাঃ খামার, রেফ, জার্নি ৯০ ও ৯’য়াদশক। গবেষণাধর্মী কাজ: কবিতা থেকে কৃত্তিবাস থেকে কৌরব – বাংলা কবিতায় নতুনের সন্ধান (Junior fellowship, Indian Ministry of Culture)।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top