thaba.in

অমিতাভ প্রহরাজ প্রসঙ্গে দেবাঞ্জান দাস

শেয়ার করুন

বেবির শোয়ানো মুখটা ভুলতে চাই

 

বেবি, অর্থাৎ অমিতাভ প্রহরাজকে প্রথম যেদিন দেখেছিলাম সে’কথা আজ আর ঠিক মনে পড়ে না। আমি তখন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে চলচ্চিত্রবিদ্যায় স্নাতকোত্তর পড়ছি। অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় আমার সহপাঠী। আমরা যাদবপুর থেকে একটু এগিয়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া (এখন অবশ্য লোপাট হয়ে যাওয়া) অন্নপূর্ণা গ্লাস ফ্যাক্টরির কাছে চিত্তরঞ্জন কলোনির মেসে থাকি। ২০০২ সাল। বেবিকে তার আগে আমি চিনতাম না। চেনার কথাও নয়। আমরা একসাথে বড় হইনি, এক স্কুল-কলেজে পড়িনি, এক জায়গার মানুষও নই। বেবি দুর্গাপুরে বড় হয়েছে। সেখানেই উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছে। তারপর পড়তে গেছিল জলপাইগুড়ি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে – মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং। BE পাশ করে সে CAT দিয়ে MICA-তে Management Communications নিয়ে পড়তে যায়। অনির্বাণ দুর্গাপুরের ছেলে এবং বেবির বাল্যবন্ধু। যাদবপুরে আসার আগে, দুর্গাপুরে থাকাকালীন, ২০০০ সালে তারা সূচনা করে ‘বৈখরী ভাষ্য’ পত্রিকার। অনির্বাণের বন্ধুত্বের সূত্রেই MICA থেকে পাশ করে এ্যাডভার্টাইজিং এজেন্সিতে কপিরাইটারের চাকরি খুঁজতে কলকাতা আসা বেবি চিত্তরঞ্জন কলোনি চত্বরের মেসে থাকতে আসে। আমার সাথে বন্ধুত্বের শুরুয়াদ।   

বেবির সাথে যখন আমার আলাপ সে’সময়ে কবিতা নিয়ে তার অনেক দূর অবধি ভাবনা বিস্তৃত হয়েছে – জীবনে লেখালিখিটাই করবে, কবিতা লিখবে এবং কবিতা লেখাকে সরাসরি পেশা হিসেবে গ্রহণ করবে না। এই ভাবনা থেকেই CAT উত্তীর্ণ অমিতাভ IIM Indore-এ পড়তে না গিয়ে বেছে নিয়েছিল MICA-র Management Communications। এই বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে জলপাইগুড়িতে কাটানো দিনগুলোর এক প্রবল ভূমিকা আছে। জলপাইগুড়ি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়ার সময় অমিতাভ প্রহরাজ, ইন্দ্রনীল ঘোষ, ইভলীন ভূঞ্যা, কৃশানু পাল, দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, বুলবুল, রুমা বিশ্বাস, সৌরভ মজুমদার, সৈকত সেনগুপ্ত-এর মত সহপাঠীরা একটা পত্রিকা শুরু করে – ‘রুকরুকা’। কলেজের গা ঘেঁষে যে নদীটা বয়ে যায় তার নামেই পত্রিকা। সৈকত ও দেবপ্রিয়কে আমি কোনদিন দেখিনি। পরবর্তীকালে ইন্দ্রনীলের সাথে আলাপ, বন্ধুত্ব, পত্রিকা যাপন—আজও তা অক্ষুণ্ণ আছে। বেবি ও ইন্দ্র—দু’জনের কাছেই শুনেছি সৈকত নাকি অসাধারণ ক্রিয়েটিভ ছেলে ছিল। আজ সে অবশ্য আর লেখালিখি করে না। কলেজে বেবির আর এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল কঙ্ক—এরা প্যারানর্ম্যাল সোসাইটি চালাতো। বেবি ও ইন্দ্র—আমাদের সময়ের দুই অন্যতম শক্তিশালী কবি, সৈকত, দেবপ্রিয়, কঙ্ক—সব মিলিয়ে কলেজের আবহাওয়া কেমন তুরীয় ছিল তা নিশ্চয় আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ‘রুকরুকা’-র সূত্রে ওদের আলাপ হয় জলপাইগুড়ি শহরের কবিদের সাথে। তখনও শ্যামল সিংহ বেঁচে। রয়েছেন কবি বিজয় দে, কবি প্রবীর রায়, কবি সমর রায়চৌধুরী। কিন্তু এই অধিকতর বয়োজ্যেষ্ঠদের পেরিয়ে ওরা স্বভাবতই ঘনিষ্ঠ হয় ‘৯-এর দশকের দুই শক্তিশালী কবি নীলাদ্রি বাগচী ও দেবাশিস কুণ্ডুর। জলশহরে, কলেজের হস্টেলে দেবাদা, নীলাদ্রিদার সাথে আড্ডায় কবিতা চর্চার নতুন পরিসর খুলে যায়। তাই আর আশ্চর্য হই না, অমিতাভ ও ইন্দ্রনীল–দুই বন্ধু–পরবর্তীকালে কবিতা লেখাকে সর্বাধিক প্রাধান্য দিয়ে নিজেদের কেরিয়ার অপশন বাছে, বা বলা ভালো, কেরিয়ারের তোয়াক্কা করে না। 

অমিতাভ অনেক ছোট থেকে কবিতা লিখেছে। ওদের বাড়িতে অমিতাভ’র মা, কাকিমা,-এর গল্প-উপন্যাস পড়ার ঝোঁক ছিল। দুর্গাপুরের ডি সেক্টরে ওদের কোয়ার্টারে ঢুকলে একটা দেওয়াল আলমারিতে বাঁধানো দেশ পত্রিকা চোখে পড়ত। সেই ছোটবেলা থেকে ‘রুকরুকা’ পর্যায়ের লেখালিখির দিকে ঘুরে তাকালে দেখা যায় ঐ সময়কালে অমিতাভ মূলত ছন্দ ও ছন্দের সৃষ্টিশীল প্রয়োগ নিয়ে কাজ করছে লেখায়। নীলাদ্রিদার সূত্রে ইতিমধ্যে তৎকালীন ‘বিজল্প’-এর সাম্যব্রত জোয়ারদার ও তাপস কুমার লায়েকের লেখার সাথে পরিচয় হয়েছে। এবং অবশ্যই ডানা মেলে আছে তৎকালীন জয় গোস্বামীর সব অবিস্মরণীয় লেখা। ‘৯-এর দশকে যাদের ছেলেবেলা কেটেছে এবং যারা মূলত মূলধারার কবিতাই পড়ার সুযোগ পেয়েছে তাদের কবিতা ভালবাসার পিছনে জয় গোস্বামীর ‘ক্রীসমাস ও শীতের সনেট গুচ্ছ’, ‘উন্মাদের পাঠক্রম’, ‘ঘুমিয়েছো, ঝাউপাতা’-র এক দুর্নিবার প্রভাব অনস্বীকার্য। সাম্যদার (জোয়ারদার) বাড়ি থেকে বেবি চুরি করেছিল আনন্দ পাবলিশার্স-এর ১৯৯০ সালে প্রকাশিত জয় গোস্বামীর ‘কবিতাসংগ্রহ’। বেবির থেকে ঝেড়ে দিয়েছিলাম আমি—প্রথম পাতায় সাম্যদার নিজ হাতে লেখা নিজের কবিতা—আজও আমার বইয়ের তাক খুঁজলে পাওয়া যাবে। নিশ্চিতভাবে ‘রুকরুকা’-র কবিদের লেখায় সেই প্রভাব, ভালোলাগার ছাপ ছিল। কিন্তু মাত্র ১৯/২০ বছরের বাচ্চা অমিতাভ’র লেখায় কবিতার সাথে কবিতা ভাবনার সম্পৃক্তির যে প্রয়াস দেখা যায়, ঐ বয়সে, তাকে কুদোস জানাতেই হয় – 

আমার হাতমুঠ্‌ ভর্তি ঘরদোর, তৈরি রংজাল 

রেখান্তরে টান বারান্দা 

কবজি থেকে আঙুল অব্‌ধি হাঁটতে গেলে 

চিত্রিত সিঁড়িজাত, স্পর্শাতীত 

সিঁড়িপথে আমার লঞ্চ উঠে আসে 

নোঙরিত জলযান আঙুলডগায় 

আমার হাতমুঠ, ভর্তি ঘরদোর, ভর্তি জলযান 

আমার হাতমুঠে বিন্দু লোভ — এ্যাসেক্সুয়ালি বেড়েছে কবিতা

আমার হাতমুঠ নামতার মতো কাঁপে আমার চেতনা 

                                               হাত এক্কে হাত 

      হাত দুগুণে ঘর 

                                               হাত তিনে কাব্য 

                                               হাত চারেতে অকাব্য       হাত পাঁচে…। 

[‘লখিন্দরের দশটি ঘোড়া’ সিরিজের প্রথম কবিতা/’রুকরুকা’/সম্ভবত ২০০০] 

এই সময়েই ‘রুকরুকা’-র কবিদের ‘কবিতা ক্যাম্পাস’ কবিতা ধারার সাথে পরিচয় হয়ে গেছে। পড়া হয়ে গেছে কবি স্বপন রায়ের ‘ডুরে কমন রুম’। যতদূর মনে পড়ে, সৈকত সেনগুপ্তের মামারবাড়ি ছিল খড়গপুরে স্বপনদা’র (রায়) বাড়ির পাশে। সেই সূত্রেই জলপাইগুড়ি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের হস্টেলে এসেছিল একখান ‘ডুরে কমন রুম’। এটা এমন এক সময় যখন ‘দেশ’ পত্রিকা নিয়ন্ত্রিত ধারা কবিতা এক্সজস্টেড হয়ে গেছে। কবিতা ছন্দ সর্বস্ব হতে হতে এক পৌনঃপুনিক, সম্ভাবনাহীন ও দাদা-দিদিদের মুখ চাওয়াচায়িতে সীমাবদ্ধ হয়েছে। দাদাদের ড্রয়িং রুমে মুখ কাঁচুমাচু করে হাজিরা না দিলে, রবিবাসরীয় আড্ডায় প্রেজেন্ট স্যর না বললে কবিতা ভোঁকাট্টা। এই সময় ‘৮-এর দশকের কিছু প্রথাভাঙ্গা কবিতা ভাবনা আকৃষ্ট করে ‘৯-এর দশকের মাঝ থেকে শেষে কবিতা চর্চা শুরু করা যুবাদের। সম্ভাবনার হাওয়ায় বুক ভরার অবকাশ আনে ‘কবিতা ক্যাম্পাস’, ‘নতুন কবিতা’, ‘কবিতা পাক্ষিক’-এর মতো পত্রিকাগুলি। এরা নতুন কবিদের প্রশ্রয়স্থল হিসেবে চিহ্নিত হয়। আজও যখন ছন্দ, বানান, বাক্য গঠনরীতি নিয়ে ফোকটিয়া মাস্টারি দেখি, হাসি পায়। মনে পড়ে সেই দিনগুলির কথা—এক্সপ্রেশনের ইউনিকনেস ছাড়া বাকি কিছু নিয়ে তেমন ভাবার প্রয়োজন বোধ করেনি সে’সময়—সেই ২০১০ অবধি সময়কাল-শূন্য দশক, অমিতাভ প্রহরাজ কলকাতায়। 

  রোগা, ডানহাতে পেতলের বালা পরা, গায়ের রঙ বেশ কালো ছেলেটিকে মেসে প্রথম দেখে মজা পেয়েছিলাম—কথা বলতে বলতে তুতলে গেলে সে দমাদম কিল মারে নিজের উরুতে। অনির্বাণের সাথে মাঝেমাঝে আসছে আমাদের মেসে। আমি, অনির্বাণ ও অমিতাভ তখন আলাদা আলাদা তিনটে মেসে থাকি। আমাদের মেসে আমার ঘরে আর এক সহপাঠী পলাশ বিশ্বাস থাকত। ফলে ঐ দুই চৌকিতে আমরা চারজন বসে আড্ডা দিতাম। রাত ন’টার পর মেসের দরজা বন্ধ। আমাদের ঘরের ঠিক বাইরে জানালা ঘেঁষে কোমর অবধি ছোট্ট পাঁচিল ছিল। সকাল ও রাত ৯’টার পর সেই পাঁচিলে এসে বসত চাটু (অনির্বাণ) ও বেবি—আড্ডা চলত জমিয়ে। আমরা তিনজন চলচ্চিত্রবিদ্যার ছাত্র, তখন বিভিন্ন ছবি দেখছি, তাই নিয়ে আড্ডা দিতাম। বেবি লেখালিখি, ল্যাটারাল থিংকিং, বিজ্ঞাপন, বামফ্রন্ট, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে সিপি-এর বিরুদ্ধে লড়ে SFI-এর ইউনিয়ন দখল। পলাশের অভিনয় নিয়ে উৎসাহ ছিল। অসাধারণ অভিনয় করত স্টেজে। আমি ইউনিভার্সিটির ডিপার্টমেন্টাল ফ্রেশার্স-এর জন্য একটা নাটক লিখেছিলাম। পলাশ তার মুখ্য অভিনেতা। অমিতাভ সেই নাটকের অভিনয় নিয়ে নানারকম ইনপুট দিত, হাবিব তনভির, নানা পাটেকর, কমল হাসানের অভিনয় নিয়ে বলত। তখনও বেবিকে আমি ‘তুমি’ সম্বোধনে ডাকি। একটু বিস্ময়ের চোখেই দেখি। শুনেছি তার জলপাইগুড়ি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়ার সময় মদ খেয়ে লিভারের ব্যথায় হাসপাতালে ভর্তি থাকার কথা। একদিন রবীন্দ্র সদনে ওর মেশানো বোতল থেকে মদ খেতে খেতে বললাম—এত মদ কেন খাও? শুনেছি তোমার শরীর খারাপ, মদ খাওয়া বারণ। ব্যাটা উড়ে বামুন সে’হেন ভালোমানুষি কথা শুনে আমায় দু’হাত নিয়েছিল বেশ। কেবল ধাই কিড়িকিড়ি বলতেই যা বাকি রেখেছিল। পরে অবশ্য ঝগড়ায়, উদযাপনে একসাথে মদের বোতল ভেঙ্গেছি মেসের দেওয়ালে। ফেরিনির বাংলা। মমতাময়ী বাংলা নয়। সে জানান দিত যে সে নামছে। এবং অমিতাভ আমাদের শিখিয়েছিল বিলেতি মদ জল মিশিয়ে খেতে হয়, বাংলা জল ছাড়া সরাসরি। ভাগ্যিস অভীক বন্দ্যোপাধ্যায় একদিন আমাদের মেসে আড্ডা দিতে এসে আমাদের সেহেন মদাভ্যাস দেখে অবাক হয়ে বলেছিল—এটা তোমরা কী করছ! ওর এই বিস্ময় আমাদের নিশ্চিত আলসার থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। আমরা তখন একই মেসে থাকি—চিনির মেস। নিচে বিছানা করে চারজন শুই। আমি আর চাটু রান্না করি। নেশা, পড়া, ফ্ল্যাট ফিলিপসের টেপ রেকর্ডারে শোভা গুর্তু-ইন্ডিয়ান ওশিন-পিঙ্ক ফ্লয়েড-সুমন চাটুজ্জে-গুলজার-দেবব্রত-পীযুষকান্তি শোনা, কবিতা চর্চা, ফিল্ম নিয়ে নিরন্তর কথা বলা এবং বৈখরী—এক তুরীয় যাপন।  

অমিতাভ, ইন্দ্রনীল, অনির্বাণ—তিনজনেই আমার বন্ধু এবং তিনজনেই লেখালিখিতে আমার সিনিয়র। স্কুল লেভেলে দু’এক পাতা কবিতা লেখার পর, আমি আর লিখিনি। প্রথমত অনির্বাণ এবং অমিতাভ—এই দু’জনেই আমাকে আবার লেখালিখির মাঝে এনে দাঁড় করিয়েছিল। সুতরাং অমিতাভ’র সাথে প্রথম খালাসীটোলা, প্রথম বারদুয়ারী, প্রথম গাঁজা পার্ক, প্রথম অলি পাব—এটুকুই সব নয়। অমিতাভ’র সূত্রেই প্রথম জলজ্যান্ত এক সিনিয়র কবি নীলাদ্রি বাগচী আমাদের মেসে মাল খেতে আসে। সারাদিন ধরে মেস থেকে নিরবচ্ছিন্ন মদে সারা কলকাতা ঘুরে আমরা সাম্যদার সাথে রাত শেষ করি কেওড়াতলা শ্মশানে। বেবির সূত্রে আড্ডা দিতে মেসে আসে বারীনদা (ঘোষাল) ও স্বপনদা (রায়)—কবিতা নিয়ে সেই তুমুল আড্ডার মাঝে ঝগড়া শুরু হয় আমাদের—রাগে উত্তেজনায় বাংলার বোতল দেওয়ালে ছুঁড়ে ভাঙ্গি আমরা। এ’সমস্ত উদযাপন তখনও ‘টক্সিক’ হয়নি। কেবল ধরতে চাইছে এক বেপরোয়াকে, যে ভবিষ্যতে অমিতাভ প্রহরাজের হাতে ‘বৈখরী’-র পোস্টমর্টেম কলম শুরু করবে, লিখবে “জয় চটুল বৈখরী”। “বাবুরাম সাপুড়ে / কোথা যাস বাপুরে / আয় বাবা দেখে যা / দুটো সাপ রেখে যা”-র রিক্রিয়েশনে বেবি “প্রাক্তন প্রিয় কবি” জয় গোস্বামী ও “এখনকার জানেমন” স্বপন রায়ের স্টাইলাইজেশন, ম্যানারিজমকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করবে –  

জয় গোস্বামী 

এসেছো সর্পিল? ছুঁয়েছো এই বাবুরাম দোয়েলের ছায়া?

তোমার অন্ধগুলো কুড়োতে আসছে বৃষ্টি দুধের দাঁত 

তুমি তো বোঝোনি তোমার মুকুল দেখেছে অরূপের ফণা 

যাচ্ছো সর্পিল? সত্যি চলে যাবে? 

তাহলে আমার চুল বেঁধে দাও দুজন সাপের মায়ায়… 

স্বপন রায় 

সা পুড়ে যাচ্ছে গা-এ তার রে 

আঁশ যাচ্ছে 

কাউকে ডাকনামে ডাকছি, কাউকে ভেনামে 

বাবুরাম পেরিয়ে তোমার কাছ ফিরছে 

ভাবো ফেরা নিজেই ফেরারি 

ভাবো বীন 

বিনা হয়ে উঠবার ডাক 

ঠাণ্ডা ডালিমের সুতো দুটো রাখতে এলাম 

জিগজ্যাগ জ্বর কতদূর? 

যে বিষ খায় সে কখনো সাপ নয় 

[বৈখরী ভাষ্য, ২০০৬] 

স্টাইলাইজেশন, এমনকি ম্যানারিজমও, কবির অর্জন। ভাষা এবং স্টাইলাইজেশন কবিকে বিশিষ্ট করে। সেখান থেকে যে ম্যানারিজম আসে, সে আবার কবিকে সীমায়িত করে। নিজের স্টাইলাইজেশনকে, ম্যানারিজমকে অতিক্রম করতে না পারলে পৌনঃপুনিকতার জন্ম দেন কবি।  অমিতাভ তার ‘জয় চটুল বৈখরী’-তে কবি জয় গোস্বামী ও কবি স্বপন রায়ের যে স্টাইলাইজেশন, ম্যানারিজম চিত্রিত করে তা প্রশ্নাতীত কিনা—তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হল নিজের দুই প্রিয় কবির কবিতা ভাবনা নিয়ে বেপরোয়া কথা বলার প্রতিস্পর্ধা ও উইট—দুটোই সে দেখিয়েছিল। শুরু থেকেই নতুন কবিতার কবিতা ভাবনার প্রতি কিছু মতপার্থক্য ছিল আমাদের প্রত্যেকের। একই সাথে যে সম্ভাবনার কবিতার কথা শুনিয়েছিল বারীনদা সেটা আমাদের সামনে নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছিল—আমরা আকৃষ্ট হয়েছিলাম নতুন কবিতা ভাবনায়। বারীনদা, স্বপনদা, রঞ্জনদা (মৈত্র)-দের ভালবাসা, প্রশ্রয় ছিল প্রশ্নাতীত। ‘চলো সিঙ্গলহ্যান্ড’ বেরোনোর পর বইমেলায় ‘কৌরব’-এর স্টলে বেবির সাথে আমি গেছি—বারীনদা বসে আছে, কমলদা এসে ঢুকল। বেবির বই হাতে প্রবল উৎফুল্ল বারীনদা কমলদাকে বলল—দ্যাখ দ্যাখ…কোনদিন তাস খেলেছিস জীবনে…দ্যাখ। তারপর দুই বুড়োর আদর শুরু হল বেবিকে। অনেক পরে বেবির সাথে ‘নতুন কবিতা’-র একটা দূরত্ব তৈরি হয়। বছর তিনেক লেখালিখি বন্ধ রাখার পর সে তখন আবার ফিরেছে লেখায়। শ্যামবাজারে থাকে। ২০০১২-১৩ সাল সম্ভবত। বাংলা ভাষা নিয়ে কাজ করছে, গদ্য-পদ্যের সীমানা পেরিয়ে লেখার কনসেপ্টে পৌঁছতে চাইছে ‘লেখাম্যান’। সে’সময় ফেসবুকে কবিতা ভাবনা ও ভাষা ভাবনা-র তাত্ত্বিক দূরত্ব তৈরি হয় বারীনদার সাথে বেপরোয়া অমিতাভ’র।  

বেবির নিজের কি স্টাইলাইজেশন, ম্যানারিজম ছিল? বারীন ঘোষালের সমালোচনা করা অমিতাভ কি চেয়েছিল ‘কাল্ট’ হয়ে উঠতে? সে কি গিমিকসর্বস্ব ছিল? সে আলোচনা পরে কখনও করব। আপাতত বলার এই বেপরোয়া উইট, প্রতিস্পর্ধা কেবল এ্যালকোহল জারিত নয়। এ একান্তই চর্চিত। কিন্তু “সকল নিয়ন্ত্রণ মুক্ত” এক অস্বীকার, ভাবনার স্তরে পৌঁছানোর তাগিদে যে এ্যালকোহল আসক্তির জন্ম নেয় সেটাই একদিন ‘টক্সিক’ হয়ে ওঠে, দেওয়াল গেঁথে দেয় ভাবনার সামনে। পিছনে ফিরে তাকালে সে’কথা মনে পড়ে। বিশেষত অমন শিশুর মত হাসতে পারা বেবির মুখে পোস্টমর্টেম ঘরের বাইরে যখন মাছি বসছিল, সেই মাছি তাড়াতে তাড়াতে কোথাও দুদ্দাড় শব্দে দরজা-জানালা বন্ধ হচ্ছিল। শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার আগে বেবির আস্তানা থেকে ওর জিনিসপত্র বের করার সময় চার বোতল বাংলা মদ—একটা আধখাওয়া, পচা খাবার, রেডি ওআরএস-এর টেট্রা প্যাক, অজস্র বই, কাগজ, ধুলো মাখা দুর্গন্ধময় বিছানা আর ল্যাপটপ বের করেছিলাম আমরা। এই মৃত্যুকে কি স্বেচ্ছামৃত্যু বলব? না, অজ্ঞাতসারে, কাউকে কিছু বোঝার সুযোগ না দিয়েই এমন অসময়ের মৃত্যুকে আমি গ্লোরিফাই করতে পারব না। একে ডিহাইড্রেশন অবহেলা করার এক টক্সিক মৃত্যুই বলব। আগামীর প্রতি এটুকু দায় তো থাকেই। নিশ্চিত বেবিও আপত্তি করত না। যেমন শেষ দেখা হওয়া বইমেলায় মদ খাওয়া নিয়ে বকাবকি করায় ঘাড়টা নেড়ে দুলতে দুলতে মিটিমিটি হাসছিল।  

বেবির বোতল থেকে মদ নিয়ে খাওয়া ভয়ঙ্কর ব্যাপার ছিল। এক সিনিয়র কবির সাথে সেই নিয়ে তো প্রায় মারপিটই বেঁধে যায়! কিন্তু আমরা বন্ধুরা কেউ বেবসের কাছে মদ চেয়ে পাইনি—এমনটা কখনও ঘটেনি। সারাজীবন যে মানুষ লিটল ম্যাগাজিন আর ফেসবুকে লিখে গেল—ঐ কবিতা লেখাকে জীবিকা করব না, জুনিয়রদের মসীহা থেকে গেল—জুনিয়র আর বন্ধুদের জন্য তার কোনো কার্পণ্য ছিল না। হিসেব সে জীবনে কোনদিন করেনি। ফলে হিসেব মেলা না মেলার প্রশ্নও ছিল না। ‘চলো সিঙ্গলহ্যান্ড’ পরবর্তী ‘অন্যব্যাপার’ পর্যায় এবং তারপর কিছু অগ্রন্থিত কবিতায় অমিতাভ প্রহরাজের স্টাইলাইজেশন, ম্যানারিজম—বিশেষ্য ও বিশেষণের ব্যবহার এবং প্রতিস্থাপন—দেখা যায়। ঐ যে বললাম, কবিকে স্টাইলাইজেশন অর্জন করতে হয়। ভেঙ্গে ফেলতেও হয়। ‘লেখামো’ হয়ে ‘ঘুমোতে যাওয়ার আগের লেখা’-য় বেবি সেই ভাঙ্গার কাজটা করে। তার মাঝে আমাদের ঝগড়া, ‘বৈখরী’ নিয়ে একবুক অভিমান, কান্না, রাগ, ফেসবুক ব্লক, কিছুদিন কথা বন্ধ—এ’সব অনেক আগেই থিতিয়ে গেছে। ফেসবুকে ‘ঘুমোতে যাওয়ার আগের লেখা’ শুরু করে ফোন, হোয়াটসএ্যাপে বলেছিল—দ্যাখ আবার কবিতায় ফিরেছি, পড়ে জানা। আজ সেই সিরিজের প্রথম লেখাটা দিয়েই শেষ করব। আর কিছু বলব না। এক লেখায় তো আমার বন্ধু অমিতাভকে পুরোটা ধরতে পারব না। মনে মনে হাসি যে স্মৃতিগুলোয়, রাগ-অভিমান করি যে ঝগড়াগুলোতে আজও—তা লিখব কখনও। এক চূড়ান্ত ফর্ম কেন্দ্রিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ‘চলো সিঙ্গলহ্যান্ড’ থেকে ‘ঘুমোতে যাওয়ার আগের লেখা’-র পাঠক হিসেবে আমার ভাবনা লেখার ইচ্ছে হয়। লিখব কখনও। ওর সাথে প্রথম দেখাটা ভুলে গেছি। পোস্টমর্টেম ঘরের সামনে ওর শোয়ানো মুখটা এখনও ভুলতে পারিনি। ওটাও দ্রুত ভুলতে চাই। সেদিন লেখালিখির জগতের আমরা পাঁচজন ছিলাম—আমি, অনির্বাণ, অর্ঘ্য, প্রশান্ত হালদার, হিন্দোল গাঙ্গুলী।

অন্ধকারের মধ্যে থাকে অন্ধকার 

এই সহজ কথাটি কেউ কি জানে?

সুড়ঙ্গের মধ্যে থাকে সুড়ঙ্গ, আর কেউ না 

এমন সরল তথ্য জানে কেউ? 

আমি এক কাদা হয়ে গেছি 

শোনাচ্ছে একগাদা, হা হা 

হাসির ভেতরে কিন্তু সর্বদা হাসি থাকে না 

এ কথা মানুষ জানে 

কারণ মানুষের ভেতরে মানুষ…

বাক্য অসমাপ্ত রেখে চিরনিদ্রায় যেতে হয় 

[ঘুমোতে যাওয়ার আগের লেখা – ১]  

 

অমিতাভ প্রহরাজ

১৯৭৯ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি পূর্ব মেদিনীপুরের পানিপারুল গ্রামে জন্ম। স্কুলে ভর্তি হওয়ার সময় বয়স কম হয়ে যাচ্ছিল বলে সার্টিফিকেটে জন্ম তারিখ ১৪ই ফেব্রুয়ারি। সেই থেকে অমিতাভ’র ভ্যালেন্টাইন ডে শুরু। বাবার কর্মসূত্রে তিন/চার বছর বয়সে দুর্গাপুরে চলে আসা।সেখানেই মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক। ১৯৯৭ সালে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে জলপাইগুড়ি গভর্নমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। ২০০১ সালে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ স্নাতক অমিতাভ বিজ্ঞাপন নিয়ে স্নাতকোত্তর পড়তে আহমেদাবাদে Mudra Institute of Communications (MICA)-এ যান। বিজ্ঞাপন নিয়ে পড়াশোনা শেষ করে ২০০২-এর শুরু থেকে কলকাতায় বিজ্ঞাপন সংস্থায় কপিরাইটার, পরবর্তীকালে ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করেন। কলকাতা, দিল্লি, পুনে শহরে নানান বিজ্ঞাপন সংস্থায় কাজ করলেও পেশাগত জীবনের থেকে সে অধিকতর নিবিষ্ট ছিল লেখালিখিতে। 

অনেক ছোটবেলাতে তার লেখালিখির শুরু। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়তে পড়তে অমিতাভ ‘শতদল’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন বন্ধু জয়দীপ নন্দীর সাথে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে এসে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় তার গল্প, কবিতা প্রকাশ পেতে শুরু করে। জলপাইগুড়ি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়ার সময় কবি ইন্দ্রনীল ঘোষ-এর মতো সহপাঠী বন্ধুদের সাথে শুরু করেন একটা পত্রিকা – ‘রুকরুকা’। ২০০০ সালে দুর্গাপুরে কবি অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়ের সাথে শুরু করেন ‘বৈখরী ভাষ্য’ পত্রিকা। কবিতা, গদ্য, গল্প, টেক্সট-এর পাশাপাশি অমিতাভ প্রহরাজ আগ্রহী ছিলেন সাইকো লিঙ্গুইস্টিক্স নিয়ে। কগনিটিভ সাইকোলজির দিকপাল, প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির প্রাক্তন অধ্যাপক, গিলবার্ট হার্মান-এর সাথে তার যোগাযোগ ছিল বলে জানা যায়।

২০২২ সালের ১০ই সেপ্টেম্বর শরীর খারাপের খবর পেয়ে হাওড়ার শিবপুরে অমিতাভ প্রহরাজের বাসার দরজা ভেঙে ঢোকে অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়। অচৈতন্য অমিতাভকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে মৃত ঘোষণা করা হয়।  

প্রকাশিত বই: ‘চলো সিঙ্গলহ্যান্ড’ (বৈখরী ভাষ্য, ২০০৬), ‘অন্যব্যাপার’ (বৈখরী ভাষ্য, ২০১৩), ‘লেখামো’ (চিন্তা, ২০২২), ‘ঘুমোতে যাওয়ার আগের লেখা’ (চিন্তা, ২০২৩)।

দেবাঞ্জন দাস

দেবাঞ্জন পশ্চিমবঙ্গের শূন্য দশকের কবি। জন্মসাল ১৯৮০। ‘বৈখরী ভাষ্য’, ‘ইন্ডিয়ারি’, ‘অপরজন’-এর মত পত্রিকা-ওয়েবজিন সম্পাদনার সাথে ওতপ্রোত জড়িত ছিলেন। বর্তমানে যুক্ত আছেন ‘বসত’ পত্রিকার সাথে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের চলচ্চিত্রবিদ্যা বিভাগের এই প্রাক্তনী কলকাতার দৈনিক সংবাদপত্রে নিয়মিত চলচ্চিত্র বিষয়ক কলাম লিখেছেন, স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র এবং তথ্যচিত্র পরিচালনা করেছেন। চলচ্চিত্র ও কবিতার আন্তর্সম্পর্ক নিয়ে নিয়মিত লিখেছেন পত্রপত্রিকায়।   

প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: ‘চেনা আনফ্রেম’ (২০০৯, বৈখরী ভাষ্য প্রকাশনী, কলকাতা), ‘বিল্লিবাদল’ (২০১৪, বৈখরী ভাষ্য প্রকাশনী, কলকাতা), ‘রক্সি বিচ’ (২০২৪, মুক্তাঞ্চল, কলকাতা)।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top