লিটল ম্যাগাজিন মেলায় আলাপ হওয়া একটা তোতলা লোক
“আমার এই নাতিদীর্ঘ জীবনেই আমি এমন কিছু মানুষের নাগাল পেয়েছি — স্রেফ যাদের সান্নিধ্যের আনন্দেই অনায়াসে কাটিয়ে ফ্যালা যায় একটা গোটা জীবন। এরা দেখিয়েছে, কবিতার জন্য, সাহিত্যের জন্য, কেউ পড়বে না, কেউ পড়ে না জেনেও এই ম্রিয়মান মাধ্যমটার জন্য জীবনের সব, সবকিছু নিয়ে কীভাবে অবলীলা বাজী ধরা যায় — এদের আমি বলি কবিতা-সন্ন্যাসী।”
শুভঙ্কর দাশ, শুভ দা’কে নিয়ে লেখাটা শুরু করেছিলাম ঠিক এভাবেই, এভাবেই শুরু করতে হলো এই লেখাটাও — হয়তো আগামীতে আরো বেশ কিছু লেখা শুরু হবে এভাবেই, না হোক। বেবী দা’কে নিয়ে আমায় প্রথম লিখতে বলে দেবা দা, অর্ঘ্য দা; বৈখরী’র বেবী দা’কে নিয়ে একটা বিশেষ সংখ্যার জন্য — সংখ্যাটা হয়নি, আমার লেখাটাও লেখা হয় নি কখনোই। হালে সৌপ্তিক দা ওর নতুন পত্রিকার জন্য আবারও বেবী দা’কে নিয়ে একটা লেখা চায়। কীই বা লিখবো! বেবী দা’কে নিয়ে আদৌ কি কিছু লেখা যায়! বেবী দা’র কবিতা, গদ্য নিয়ে লিখতে গেলে যে পরিমাণ প্রাথমিক পড়াশোনার প্রয়োজন, তার জন্য আমার তিনটে মানুষ-জীবন কম পরে যাবে। বেবী দা’র জীবন, যাপন নিয়ে লিখবো! কতুটুকুই বা আমি পেয়েছি ওঁকে! বেবী দা’র সাথে কাটানো সময়গুলো নিয়ে লিখতে গেলে অবিকল অনুবাদ করতে হয় আমার চমকে উঠে স্রেফ হাঁ করে থাকাগুলো। প্রকৃত অনুভবের কোনো লেখ্যরূপ থাকে না, কেবলই থাকে কিছু খণ্ড যপনের বিস্ময়বিলাস।
একটা কলেজের কাজে এই মুহূর্তে আমি নাগাল্যান্ডের একটা নির্জন পাহাড়ের মাথায় — কী ভাষায় আমি তুলে ধরবো এই শূন্যতার সশব্দতা, নীরবতার তীব্র ঝঙ্কার, অনুরণন! গতকাল গোটা দিনটা কাটিয়েছি মালদায়। স্টেশনে নেমে টোটোওলাকে একটা সস্তার জায়গায় নিয়ে যেতে বললে, সে আমায় নিয়ে আসে মন্দিরতলার দিনপিছু তিনশ টাকার অন্নপূর্ণা লজে। রিসেপশন থেকে চাবি নিয়ে দোতলার দশ নম্বর ঘরের দরজা খুলতেই চমকে উঠি — গোলাপী চুনরঙ করা দেওয়ালের একটা সরু একফালি ঘর, মাথায় মাথায় পরপর রাখা দুটো খাটিয়া, আর খাটিয়ার পাশে একটা মানুষ চলার মতো সরু জায়গা — আমার মনে পরে গ্যালো বাগবাজার মোড়ের সোনা টেলর্সের দোতলায় হবহু এরকমই একটা ঘরের কথা, যেখানে কতো কতোদিন স্কুলের পরে একটা খাটিয়ার বসে বেবীদার লেখা শুনেছি, আর তার পাশের খাটিয়ায় বেবী দা ল্যাপটপ থেকে কবিতা পড়ার ফাঁকে ওঁর বিলিতি পাইপে ধরিয়ে নিতো সস্তার সিগারেট।
২০১৪’র লিটল ম্যাগাজিন মেলা, আমার কাছে একটা না-চেনা জগতে বেমালুম অনুমতি ছাড়াই ঢুকে পড়ার একটা ইডিয়টিক কিস্সা। ২০১৩’র জুলাই থেকে প্রতি সপ্তাহে যে হাতে লেখা জেরক্স করা পত্রিকাটা করতাম, সেটারই একটা সংকলন করেছিলাম ডিসেম্বরের দিকে, জেরক্স করেই, ডিজিটাল কভার, খবরের কাগজের কাটাকাটা অংশের একটা কোলাজ, প্রতিটা কপি স্টেপল করেছিলাম নিজেই, রাতজেগে বসে। সৌরভ দার (চট্টোপাধ্যায়) কাছে আমি জানতে পারি রবীন্দ্র সদনের নন্দন চত্বরে একটা লিটল ম্যাগাজিনের একটা মেলা হয়। সাহস করে একদিন চলে যাই খোঁজ নিতে, গিয়ে দেখি আবেদন গ্রহন চলছে। নিয়ম কানুন জেনে এসে সেই অনুযায়ী আবেদনও করে ফেলি। বিগত দুটো সংখ্যা জমা দিতে হবে, যা আমার বা আমাদের সে মুহূর্তে নেই। তাছাড়া লিফলেটের মতো যে সংখ্যাগুলো হয়ে গোটা বছর ধরে, সেগুলো জমা দিলেও হয়তো ছুঁড়ে ফেলে দেবে ডাস্টবিনে — তখন খুব হাংরি পড়ছি আমরা, এবং সেই ষোলো বছরের মেধায় আমরা অবাধ যৌনচর্চা ও কলোনিয়াল ভাষার স্পর্ধাটুকুই নিতে পেরেছিলাম মাত্র, বোধ বা চেতনা নয়। প্রতিষেধক পত্রিকার বেশকিছু সংখ্যার একটা জেরক্স সংকলন আমি চুরি করে এনেছিলাম সোহম দার (নন্দী) বাড়ি থেকে — সেখান থেকেই আবার জেরক্স করে কিছু লেখা কেটে সাদা কাগজের ওপর আঠা দিয়ে বসিয়ে তৈরি হলো ষোলো পাতার দুটো মিথ্যে সংখ্যা, পৃষ্ঠা নম্বরগুলোও একটা কাগজে প্রিন্ট করে কেটে কেটে বসানো হলো প্রতিটা পাতায়। সেটাকে আবার জেরক্স। দুটো নান্দনিক ছবি বেছে প্রচ্ছদ করা হলো — নাম দেওয়া হলো ‘প্রথাগনিস্ট’। সেবার মেলায় কোনো এক কারনে নাকি বহু নিয়মিত পত্রিকা অংশগ্রহন করেনি — শিকে ছিঁড়লো আমাদের, দুটো মিথ্যে ডামি সংখ্যার জোরে আমিরা টেবিল পেয়ে গেলাম ২০১৪ বাংলা আকাদেমির লিটল ম্যাগাজিন মেলায়। তখন আমি কাউকে চিনিনা। পাঁচ দিনের মেলার তৃতীয় দিন, ঠিক বিক্রিহীন বিগত দিনগুলোর মতোই একটা সন্ধ্যে, একটা বসে আছি টেবিলে, হঠাৎ একটা চশমা পরা লোক, সবুজ একটা গেঞ্জি, পিঠে একটা ফুলে ওঠা দামড়া স্কুল ব্যাগ, জানতে চাইলো, “তুমি একা পত্রিকা করো?” আমি সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়লে সে আমাদের একটা পত্রিকা তুলে দিয়ে দিতে বলে। তিরিশ টাকা, লিটল ম্যাগাজিন বেচে প্রথম টাকা, অনেক টাকা। তুতলে তুতলে অতি কষ্টে সে আরো বলে, লিটল ম্যাগাজিনের টেবিলে একটা রঙ ভালো লাগে না, টেবিল হবে রঙিন, আর এরকম ফাঁকা ফাঁকা তো একেবারেই না। পিঠের ব্যাগের চেন খুলে সে বের করে আনে পাঁচটা করে দুটো বই, ‘বৈখরী ভাষ্য গল্প সংখ্যা’ আর ‘অন্যব্যাপার’। একটা বৈখরীর সংখ্যা বিক্রি হলো। মেলার শেষ দিন আবার এলো লোকটা, টাকাটা আর অবিক্রিত কপিগুলো ফেরত দিতে গেলে সে বললো, টাকা দিতে হবে না, ওটা আমার তরফ থেকে তোমাদের ম্যাগাজিনে কন্ট্রিবিউশন, আর একটা বৈখরীর সংখ্যা ও একটা অন্যব্যাপার আমায় ফিরিয়ে দিয়ে বললো, “পোড়ো”। সেইদিন, বহুদিন পর, এক প্যাকের বিড়ির বদলে এক বাক্স সিগারেট কিনেছিলাম বাড়ি ফেরার পথে।
এরপর বেশ কিছু দিন আমার কাটে বৈখরীর সংখ্যাটা আর অন্যব্যাপারে — পাতায় পাতায় ভিন্ন স্বাদের লোভ। একটা বই, কেবল ভাষাগতভাবে নয়, তার আকৃতি, প্রেজেন্ট্রশন, সব দিক থেকে আমার আঘাত করতে থাকে অবিরাম। একটা চওড়া বই, সে কি কবিতার! কবিতার বই তো কেবল কবিতারই, ভাঙা লাইন — আর গল্পের বই গল্পের, গোটা গোটা লাইন, জাসটিফাই অ্যালাইনমেন্টে। এখানে তো দুইই আছে — লেখাগুলোও ঠিক কি! গল্প না প্রবন্ধ! কোনো সমীকরণের ঠিক ফেলা যাচ্ছে না একে। তারওপর, বিভিন্ন ছবি ও ছবির ওয়ানলাইনার কমেন্ট্রিও এমনভাবে একটা বইয়ের টেক্সটের অংশ হয়ে উঠতে পারে, ইলাস্ট্রেশন নয়, য্যানো ওগুলোও একেকটা ইন্ডিভিজুয়াল টেক্সট, সেই সময় আমার কাছে প্রকৃতই একটা অন্যব্যাপার।
তার কিছু দিনের মাথাতেই এলো ফোন, চলে আয় বাগবাজারে, সোনা টেলর্সের দোতলায়, পত্রিকা নিয়ে কথা আছে। হিন্দু স্কুলে পড়ি তখন, একদিন স্কুল কেটে দুপুর পর্যন্ত সময় কাটলো প্রেসিডেন্সির ট্যাঙ্কির চাতালে, দুটো রাউন্ড ছিলিম শেষে হেঁটে পৌঁছালাম বাগবাজার। ফোন করতেই নেমে এলো ঝাঁকড়া চুলের লোকটা আর শুরু হলো আমার বেশ কিছু মাসের ভৌতিক যাপনের একটা অন্য অধ্যায়। সেই দিনই লোকটা, অমিতাভ প্রহরাজ থেকে নেমে এলো বেবী দা-এ। একফালি ঘর, মাথায় মাথায় পরপর দুটো চৌকি, সামনেরটায় এক্সটেনশন কেবিল, খালি সিগারেটের বাক্স, ঝুল, ধূলো, কাগজ, দুটো বাতিল পেন, একটা খারাপ লাইটার, ব্যাগ আর অজস্র বই। অন্যটায় শোয় বেবী দা। জানতে চাইলো, তোরা তো হপ্তাক কাচরা, হপ্তায় হপ্তায় পত্রিকা করিস, আর করছিস না! পত্রিকা করার আগে জানতামই না একটা লিটল ম্যাগাজিন ঠিক কেমন দেখতে হওয়া উচিৎ, কেমন হয়, গত মেলায় গিয়ে দেখেছি, জেনেছি — এবারে পত্রিকা করলে ওভাবেই করবো, দুটো মলাট থাকবে, প্রচ্ছদ, নিজের বসে বসে অসমান পিন মারা নয়, একটা প্রপার বাইন্ডিং হবে, হাতে লিখে বা সাইবার ক্যাফেতে একপাতায় টাইপ করে কেটে কেটে সাদা কাগজে বসিয়ে জেরক্স নয়, পত্রিকা হবে ছাপা, ভালোভাবে, যেমন হয় আরকি, একটা বা দুটো এফোর নয়, অন্তত ষোলো পাতা; জানালাম। এও জানালাম, কীভাবে এসব করে, কতো খরচ, জানিনা কিছুই। বেবী দা জানায়, তোদের পাড়াতেই তো প্রেস, নম্বর দিয়ে দেবো — লেখা জোগাড় করে ওদের দিয়ে দিলেই হবে, ওরাই করবে সব, ডিটিপি, ডিজাইন, কম্পোজ, প্রুফটা শুধু দেখে দিতে হবে নিজেকে, পিওডি তখনো অতোটাও সুলভ নয়, একটা ষোলো পাতার কাগজ একশো কপি করতে দেড় হাজার টাকা পরবে অন্তত। দেড় হাজার! আমি রোজ স্কুলে যাওয়ার জন্য পাই কুড়ি টাকা, বাসে স্কুল যাওয়ার জন্য লাগে ছ টাকা, তিনটার দৈনিক বিড়ি, হেঁটেই ফিরি রোজ কলেজস্ট্রিট থেকে বরানগর, হেঁটে ফেরার সময় একটা সিগারেট খেলে দৈনিক বাঁচে নয় টাকা, না খেলে এগারো টাকা — ছুটির দিন বাদে মাসের শেষে মেরেকেটে জমে দু’শো থেকে আড়াইশো, ভৌতবিজ্ঞান স্যারের মাইনে না দিলে আরো তিনশো টাকা — এরমধ্যে আছে প্রতিমাসে দু-তিনটে বাংলার তেত্রিশ টাকার ছোটো বোতল। উপায়টাও বলে দিয়েছিলো বেবী দাই, জেরক্সই কর, নিজে কম্পোজ কর, মাইক্রোসফ্ট পাবলিশার্সে, কিছু বেসিক অপারেশন দেখিয়ে দিয়েছিলো বেবী দাই, অতো মোটা ও জটিল অন্যব্যাপার বইটাও নাকি ওঁর নিজেরই কম্পোজ করা, পাবলিশার্সে — বাংলা ওয়ার্ডে নয়, টাইপ হবে অভ্রতে, সেখানে ফন্ট অনেক বেটার, বেশি, টাইপ করাও সোজা, বাংলা উচ্চারণ ইংরাজিতে এসএমএসের মতো টাইপ করলেই ফুটে উঠবে বাংলা অক্ষর, দেখালো হাতে কলমে, আর ‘য-ফলা’, ‘ৎ’, চন্দ্রবিন্দু, হসন্তের মতো জটিল ব্যতিক্রমী অক্ষরগুলোর শিখিয়ে দিলো আলাদা করে। ডিজিটাক কম্পোজ আর ডেক্সটপ পাবলিশিং-এর একটা দীর্ঘ ক্লাস, আর আমি অঙ্ক খাতার পেছনে টুকে চলেছি অনুগত ছাত্রের মতো, সেদিন আর পড়তে যাওয়া হলো না। তবুও, নিজের ল্যাপটপ বা কম্পিউটার নেই, লেখালিখি ও পত্রিকার বন্ধু শুভমের (দাঁ) ক্লাস টুয়েলভের পর পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়া বন্ধু যে সাইবার ক্যাফেতে কাজ করে, সেখানে একঘন্টার দশ টাকা দিয়ে গোটা স্কুলের সময়টা কাটালেও পাবলিশার্স আর অভ্রতে চোস্ত হতে সময় লাগবে। অথচ পরের সংখ্যার লেখা জোগাড় শুরু হয়ে গেছে — বেবীদার কবিতা, মধুবন্তী লেখা দিয়েছে, উল্কা-ঋষিসৌরক-অতীন্দ্রিয়-সম্বুদ্ধ দা এরাও, যারা প্রতিষেধকে লেখে, আমি একটা লেখা লিখেছি রমানাথে বসে, যৌনতা আর খিস্তিখেউরের বাইরের একটা লেখা। বেবী দা নিজেই টাইপ করে কম্পোজ করে দেবে বললো এই সংখ্যাটা, হপ্তাক কাচরার দ্বিতীয় বছরের প্রথম সংখ্যা, একটা লিটল ম্যাগাজিনের একটা সংখ্যা ঠিক যেরকম দেখতে হওয়া উচিৎ।
দ্বিতীয় মুলাকাতে বেবী দা’র থেকে পেলাম একটা উপহার, মনীন্দ্র গুপ্তর গদ্য সংগ্রহ, দ্বিতীয় খণ্ড। বেবী দা বোঝালো কীভাবে একটা লেখার চরিত্রও মানুষের মতোই — তারও একটা জন্ম আছে, জীবন আছে, মৃত্যু। লেখকের মাথার ভেতরের প্রথম লেখা, তার লিখে ফ্যালা দ্বিতীয় লেখা আর সেই লেখা পড়ে পাঠকের মাথায় তৈরি হওয়া তৃতীয় লেখা — তারা ঠিক কতোটা আলাদা একে অন্যের থেকে, মিলই বা কতোটা! অন্য আরেকদিন পেলাম বেবী দারই একটা বই, ধোঁয়া-ধূলোর ভেতর থেকে খুঁজে বের করা, “চলো সিঙ্গল হ্যান্ড” — বইটা পড়ে আমি স্রেফ ছেৎরে গেছি। একেকটা কবিতা চারলাইনের, দ্বিতীয় কবিতাটা চারটে লাইন আসলে প্রথম লেখারই মিরর ইমেজ — বেবাক আবেগ মন্থন বা প্রেম বা প্রেমহীনতা বা নিদেন কোনো নির্দিষ্ট বার্তা দেওয়ার দায়বদ্ধতার বাইরে বিমূর্ত কবিতার চরাচরে শুরু হলো আমার বিকল্প কবিতা দ্যাখা। কতো কতো সন্ধ্যে স্কুলের জামা পড়ে বসে থেকেছি বেবী দার ঘরে আর কবিতা ও সেই ঘরের ভৌতিক ইতিহাস চর্চার মাঝে কতো কতো ছাই আর পোড়া বিড়িতে ভরে এসেছি বেবীদার খাটের পেছনে সুদীর্ঘ অ্যাশট্রে।
বেবী দা একটা বইয়ের তালিকা করে দিয়েছিলো আমায়, যেগুলো পড়ে ফ্যালা প্রয়োজন। অকপট জানাতো, পড়াশোনা কর, তোদের কোনো পড়াশোনা নেই। একটা সময় কবিতা পড়তে ভয় পেতাম বেবী দার কাছে। সটান বলতো, এসব কোনো কবিতাই নয়, কিস্যু হচ্ছে না লেখা। অথচ প্রতিদিন ঘরে ঢুকলেই বেবীদার প্রথম জিজ্ঞাটাই ছিলো, নতুন কিছু লিখলি? যে বিরল দিলগুলো বেবী দা বলে উঠতো, বাহ্, দারুণ হয়েছে, ভালো লিখেছিস, সেইদিনগুলো বাড়ি ফেরার পথে রাস্তার স্ট্রীট আলোগুলো য্যানো একটু বেশি উজ্জ্বলতা নিয়ে জ্বলতো। এই বিরল দিনগুলোর লোভেই কতো কতো কবিতা লিখেছি, হারিয়ে ফেলেছি, আবার লিখেছি। হাংরি কিংবদন্তীতে পাড়া হাড়কাটা, বেবী দার সাথেই প্রথম হাড়কাটা, ফানেলে করে খালি বোতলে ভরে মদ ঢেলে দিলেন স্থানীয় বৃদ্ধা।
এটা কোনো লেখা নয়। কোনো স্মৃতিচারণা নয়। কিছুই নয়। স্রেফ গন্তব্যহীন দেড় হাজার শব্দ। যেভাবে কতো সন্ধ্যায় গন্তব্যহীন হেঁটেছি বেবী দার সাথে — বাগবাজার থেকে দেশবন্ধু পার্ক, সেখান থেকে হাতিবাগান, শোভাবাজার, খানিকটা সোনাগাছির গলি ছুঁয়ে বি.কে. পাল, সেখান থেকে শ্যামবাজার, তারপর আমার বাড়ির বাস, বেবী দা এরপর কোথায় যেতো জানিনা সঠিক। প্রতিবার এরকম বেরোনোর সময় আলুর বস্তার মতো ফুলে থাকা পিঠের ব্যাগটা নিতো বেবী দা, থাকতো ল্যাপটপ। কেন ওটা নিয়ে বেরোও, জানতে চাইলে বলেছে, বই থাকে, ল্যাপটপ থাকে, কখনো হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ লিখতে ইচ্ছে করলে যেখানে খুশি বসে লিখতে পারবো, কখনো কিছু পড়তে ইচ্ছে করলে, হাঁটতে হাঁটতেই, কোথাও বসে কিছু একটা পড়ে নেওয়া যাবে। কোনোদিন ব্যাগটার কোনোরকম প্রয়োজন চাক্ষুস করিনি, কোনোদিন রাস্তায় হাঁটতে বেরিয়ে কোনো বই পড়তে বা লিখতে দেখিনি বেবী দা’কে, লেখেনি কোনোদিন, অন্তত আমার উপস্থিতিতে — অথচ প্রতিদিন স্রেফ আধএকঘন্টা জন্য হাঁটতে বেরোনোর সময়ও বেবী দা প্রস্তুত হয়ে বেরোতো কবিতার জন্য।
অমিতাভ প্রহরাজ
১৯৭৯ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি পূর্ব মেদিনীপুরের পানিপারুল গ্রামে জন্ম। স্কুলে ভর্তি হওয়ার সময় বয়স কম হয়ে যাচ্ছিল বলে সার্টিফিকেটে জন্ম তারিখ ১৪ই ফেব্রুয়ারি। সেই থেকে অমিতাভ’র ভ্যালেন্টাইন ডে শুরু। বাবার কর্মসূত্রে তিন/চার বছর বয়সে দুর্গাপুরে চলে আসা।সেখানেই মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক। ১৯৯৭ সালে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে জলপাইগুড়ি গভর্নমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। ২০০১ সালে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ স্নাতক অমিতাভ বিজ্ঞাপন নিয়ে স্নাতকোত্তর পড়তে আহমেদাবাদে Mudra Institute of Communications (MICA)-এ যান। বিজ্ঞাপন নিয়ে পড়াশোনা শেষ করে ২০০২-এর শুরু থেকে কলকাতায় বিজ্ঞাপন সংস্থায় কপিরাইটার, পরবর্তীকালে ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করেন। কলকাতা, দিল্লি, পুনে শহরে নানান বিজ্ঞাপন সংস্থায় কাজ করলেও পেশাগত জীবনের থেকে সে অধিকতর নিবিষ্ট ছিল লেখালিখিতে।
অনেক ছোটবেলাতে তার লেখালিখির শুরু। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়তে পড়তে অমিতাভ ‘শতদল’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন বন্ধু জয়দীপ নন্দীর সাথে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে এসে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় তার গল্প, কবিতা প্রকাশ পেতে শুরু করে। জলপাইগুড়ি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়ার সময় কবি ইন্দ্রনীল ঘোষ-এর মতো সহপাঠী বন্ধুদের সাথে শুরু করেন একটা পত্রিকা – ‘রুকরুকা’। ২০০০ সালে দুর্গাপুরে কবি অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়ের সাথে শুরু করেন ‘বৈখরী ভাষ্য’ পত্রিকা। কবিতা, গদ্য, গল্প, টেক্সট-এর পাশাপাশি অমিতাভ প্রহরাজ আগ্রহী ছিলেন সাইকো লিঙ্গুইস্টিক্স নিয়ে। কগনিটিভ সাইকোলজির দিকপাল, প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির প্রাক্তন অধ্যাপক, গিলবার্ট হার্মান-এর সাথে তার যোগাযোগ ছিল বলে জানা যায়।
২০২২ সালের ১০ই সেপ্টেম্বর শরীর খারাপের খবর পেয়ে হাওড়ার শিবপুরে অমিতাভ প্রহরাজের বাসার দরজা ভেঙে ঢোকে অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়। অচৈতন্য অমিতাভকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে মৃত ঘোষণা করা হয়।
প্রকাশিত বই: ‘চলো সিঙ্গলহ্যান্ড’ (বৈখরী ভাষ্য, ২০০৬), ‘অন্যব্যাপার’ (বৈখরী ভাষ্য, ২০১৩), ‘লেখামো’ (চিন্তা, ২০২২), ‘ঘুমোতে যাওয়ার আগের লেখা’ (চিন্তা, ২০২৩)।
দেবরূপ সরকার
জন্ম ও বেড়ে ওঠা কোলকাতা ও বরানগরে। ফাল্গুনী রায়, শৈলেশ্বর ঘোষ, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, এমনকী রামকৃষ্ণেরও এককালে হেঁটে চলে বেড়ানো এলাকায় থাকেন বলে ভয়ঙ্কর আত্মশ্লাঘায় ভোগেন। চূড়ান্ত বাচাল, অধৈর্য। আজন্ম ত্যাঁদড়। পড়াশোনা উদ্ভিদবিদ্যা নিয়ে। গবেষণার সাথে যুক্ত। ‘হপ্তাক কাচরা’ নামক একটি পত্রিকার কর্মী। কোনো লেখারই প্রকৃত অনুবাদ সম্ভব নয়, এমনটাই বিশ্বাস করেন, অথচ, রিচার্ড ব্রটিগান, ত্রিস্তঁ জারা, কার্ট কোবেন, বুকাওস্কি প্রমুখদের বিভিন্ন লেখার অনুবাদ করেছেন। একেবারেই কবিতা লিখতে পারেন না। মাঝেমধ্যে কিছু মধ্যমেধার গল্প লেখেন। লেখালিখি করেন মূলত পাঠিকাদের সাথে আলাপের লোভে এবং সাঁতারে তিনি একেবারেই পারদর্শী নন বলে। ভগবানের পেচ্ছাপ, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ময়দানে বসে বিয়ার খেতে খেতে যা যা বলবো তোমাকে, একটি বই – ইত্যাদি কিছু অপাঠ্য পুস্তক ও পুস্তিকা লিখেছেন, যেগুলো আলাদা করে কিনতে লাগেনা, লেখকের সাথে একটু হেসে একটা সিগারেট খেলে লেখক নিজেই সেটা লিখে দেন। পাহাড়ে ঘুরতে ভালোবাসেন। প্রতিদিন স্বপ্নে গোচেলা বা অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্পের মাথায় উঠে বসে থাকেন, কিন্তু বাস্তবে ৩৬০০ মিটারের বেশি উঁচুতে ওঠা হয়নি। ছবি তোলেন কেবল মোবাইল ফোনে একটা ভালো ক্যামেরা আছে বলেই। মদ খেতে ভালোবাসেন। তামাক সহ্য হয় না। চূড়ান্ত মিথ্যেবাদী। প্রবল ভীতু। ইদানিং আবার হাইপারটেনশন, উচ্চ কোলেস্টেরল ও স্পন্ডালাইটিসে ভুগছেন।