অমিতাভ প্রহরাজঃ বেবি
(SELF) Construction & DE-construction of a MYTH
অমিতাভর প্রথম দিকের খাতায় বা ডাইরি তে একটা ইংরাজি প্রবাদের উল্লেখ থাকতো – do not want to be great – “GREAT MINDS THINK ALIKE’ — আর ঠিক এই সাইকোলজি থেকেই শুরু হয় অমিতাভর ‘গ্রেটনেস’ ও ‘বেবি’ হয়ে ওঠা। আমার ধারণা নিজের জীবনের মেঝেতে অমিতাভ ঠিক এই তোশকে শুত (অমিতাভ হয়ত সুতো লিখতো)। একদিকে যেমন গ্রেটনেস স্পর্শ করার তাগিদ অন্য দিকে সেই মহত্তের বিন্দুকে লাথি মেরে রাস্তার সারমেয় হয়ে ওঠার (দামাল) শিশু সুলভ অভিপ্রায়। পোষ্য সে কিছুতেই হবে না। এ তার স্বরচিত ললাট লিখন।
অমিতাভ নির্দ্বিধায় লিখবে এমন সব লাইন যে আমাদের জিন্দা শরীর শবে পরিণত হবে – যথা:-
মৃদু দিদারের পর নিজের নক্ষত্রে ফিরে যাচ্ছে মহিষ
তাই রাত নড়ছে এ্যাতো
আমার হাতের লেখা ট্যারাব্যাকা হয়ে গুহা হয়ে গেল
তাহার ভেতর আমি কোমল ফার্নিচার আনি
(অন্যব্যাপার – পৃষ্ঠা ২৬)
—এবং এই অমিতাভ পৃথিবীর সমস্ত ঘোর কাটিয়ে বাংলা ভাষার কোমল মিষ্টি আঙ্গিকে দেশলাই দেবে ঠাণ্ডা মাথায়ঃ-
গাছের ভদ্রতার কাছে হেগে যায় রোদ
হাত ধরার এই স্টাইল
সহ্য করার এই পোজ
সিলিন্ডারের মতো গড়িয়ে এলে কাছে
(বৈখরী ভাষ্য, ষষ্ঠ বর্ষ, বইমেলা সংখ্যা, ২০০৬)
উপরিউক্ত দুই খণ্ড কবিতার মধ্যে অমিতাভ ও বেবি দুজনেই প্রবল বিদ্যমান। যেমন ‘মৃদু দিদারের পর নিজের নক্ষত্রে ফিরে যাচ্ছে মহিষ’ – পরিষ্কার নক্ষত্র মণ্ডলের দিকে উল্লেখ করে (Orion constellation) এবং সত্যি সত্যি যদি বা মহিষ যায় আশে পাশের ভুমি, মানচিত্র গাছপালাও নড়তে থাকে তাই ‘রাত নড়ছে’ এবং অমিতাভ ভীষণ লজিকাল তাই একটা গুহা খুঁজে আনে নিজের হাতের লেখা থেকে এবং আমার আপনার জন্য সেই গুহা বাড়িতে ‘কোমল ফার্নিচার’ রাখে।
অন্যদিকে স্থবির গাছের কাছে মানুষ ও সারমেয় তো হামেশাই পুরীষ রেখে আসে। আর বিকেল বা সকালে একখণ্ড রোদ ও গাছের গোড়ায় আসন পেড়ে গোল হয়ে বসতে পারে। রঙটা শুধু এক। এই ভয়ঙ্কর সরল লজিক ব্যাবহার অমিতাভ বেবি হয়ে ওঠে। ভাষার ভদ্রতাকে সে চ্যালেঞ্জ করে বোঝায় – বাংলা ভাষা একটি জীবিত শরীর যাহা বেঁচে আছে, হেগে আছে,হাত ধরে আছে – আছে সুস্থ সবল।
ভিন্ন হওয়ার তাগিদ তাড়িত ছিল অমিতাভ – এতটাই ছিল যে cheers না বলে ‘ঠকাস’ বলতো। শব্দের তিন মাত্রা থাকে যাহা খুব সহজেই ঠাউর করা যায় – লিখিত রূপ (অর্থাৎ শরীর); ধ্বনি রূপ বা উচ্চারণ এবং অর্থ বা মানে। আমার ধারণা অমিতাভ ও বেবি শব্দের এই তিনটি রূপকেই ধাওয়া করে গায়ে মেখে একটা চতুর্থ ডাইমেনশনে পৌঁছতে চাইতো। বারবার নিরন্তর সেই চেষ্টাই সে করে গেছে। লিখতে বসে অদৃশ্য সব মশা খুঁজে পেত সে – এবং ‘ঠকাস’ শব্দে সে মশাগুলিকে বধও করতো। আমি যদিও কোনদিন অমিতাভর তালুতে কোন মশার দেহ দেখিনি। লেখা কেমন দেখতে হবে, কেমন টেস্ট হবে এবং কি বার্তা বহন করবে; এ সবই অমিতাভ স্বশরীরে ধারণ করতো। লেখার শরীরকে নিজের শরীর করার কৌশল রপ্ত করে সে জলের উপর হাঁটতে চাইতো। এই যে নিজেই স্বীয় লেখা হয়ে ওঠা – রিয়্যালিটি, অভিনয়, খেউড়, শব্দার্থ নিয়ে যে চতুর্থ ডাইমেনশ তৈরি হতো সেই আসলে অমিতাভ বা বেবি। বিচিত্র জামাকাপড় – কথা বলার স্টাইল – কাঁধের ব্যাগ – চশমা এ সবই তার লেখার extension শুধু নয়; এগুলি ছিল তার লেখার জীবন্ত রূপ। রূপকে অনিহা তার প্রায় জন্মগত। তাই অমিতাভই অমিতাভর রূপক। বেবি ছিল তার নিমগ্ন ঠকাস।
বাংলা ভাষায় লিখবে বলে – শুধু লিখবে বলে অমিতাভ যা খুশি করতে উদ্যত। সে নিজেকে কনভিন্স করতো যে ‘যাহা করিবো সত্য করিবো, সত্য বই মিথ্যা করিবো না’ – তাই অমিতাভর ক্যানসার হয়, অমিতাভর হাতে একটি কল্পিত বালক খুন হয়, তার নিজের কোভিড হয় – আর তার টাকা চুরি হওয়া, ফোন চুরি যাওয়া এইসব তো লেগেই থাকত। মনে মনে এইসব কল্পিত জটিলতা বিশ্বাস করে বাকিদের বিশ্বাস করিয়ে সে লেখার প্রসেস’এ প্রবিষ্ট হতো। অর্থাৎ অমিতাভ লেখাকে একটা পারফরমিং আর্ট হিসেবে দেখত। এই যে রিয়্যালিটির ভীতরে একটা অন্য বাস্তবতা ক্রিয়েট করা, এবং সেই অন্য বাস্তবতার আওতায় রিয়্যালিটিকে নিয়ে একটা মগের মধ্যে দুটোকেই ঝালমুড়ির ন্যায় মাখানো – এই ক্রমাগত উদ্যাপনের নিমিত্ত ওর জীবন একটা লাইভ সিনেমা, নাটক, সার্কাস এবং এরকম সবকিছুর মিশ্রণ।
কিন্ত কেন সবসময় কিছু একটা খারাপই হতো – কেন এমন হতো না যে অমিতাভ কহিল ‘ শঙ্খবাবু আমায় ডেকেছেন, কবিতা শুনে প্রভূত প্রশংসা করেছেন।‘ কারণ ফুলমালার কোন ক্রাইসিস থাকে না। যদি না সেটা ছাগলের গলায় থাকে। ক্রাইসিস উদ্যাপন করতে করতে অমিতাভ লিখতো প্রচুর – সত্য সত্যই এক পৃথিবী লেখার ক্ষমতা ছিল তার। একদম অন্তর দিয়ে ও জানত বা বিশ্বাস করতো প্রত্যেকটি স্বকৃত চ্যালেঞ্জ ও স্বীয় দক্ষতায় অতিক্রম করবে। তাই প্রতিনিয়ত অমিতাভর ভেড়ার পালে বেবি বাঘ পড়ত। কিন্তু এই বেবি বাঘ অমিতাভকেই ক্লান্ত করে তুলেছিল। আমাদেরকেউ যথা। আমরা অমিতাভর বন্ধুরা অনেক আগেই conformist. এবং আমার ধারণা অমিতাভ’ও শেষমেশ গারস্থ হতে চাইছিল। আর ঠিক এই দোলনাতেই ও চলে গেল; স্রেফ নেই আর।
অমিতাভ কোন ট্রাজিক নায়ক নয় – ঢালু রাস্তায় কোন রোমান্টিক নস্টালজিক সাইকেল ও নয়। সে এক আদ্যপান্ত আর্টিস্ট। অমিতাভ একটি কাক পুষেছিল – যাতে সেই কাক বাস্তববোধের প্রতিনিয়ত চুনকাম করে আসে। এই কাকটিকে পিঠের ব্যাগে পুরে প্রতিদিন সে বের হতো রাস্তায় লেখার খোঁজে। অমিতাভ কিন্তু জানত বেবি কাক রাত্রে ভাল দেখতে পায়না। তাই
ওই প্রথম মলাটের বুকে জাগে
অপ্রকাশিত কুকুর ও অক্ষর
(অন্যব্যাপার – পৃষ্ঠা ১৮২)
অমিতাভ প্রহরাজ
১৯৭৯ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি পূর্ব মেদিনীপুরের পানিপারুল গ্রামে জন্ম। স্কুলে ভর্তি হওয়ার সময় বয়স কম হয়ে যাচ্ছিল বলে সার্টিফিকেটে জন্ম তারিখ ১৪ই ফেব্রুয়ারি। সেই থেকে অমিতাভ’র ভ্যালেন্টাইন ডে শুরু। বাবার কর্মসূত্রে তিন/চার বছর বয়সে দুর্গাপুরে চলে আসা।সেখানেই মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক। ১৯৯৭ সালে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে জলপাইগুড়ি গভর্নমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। ২০০১ সালে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ স্নাতক অমিতাভ বিজ্ঞাপন নিয়ে স্নাতকোত্তর পড়তে আহমেদাবাদে Mudra Institute of Communications (MICA)-এ যান। বিজ্ঞাপন নিয়ে পড়াশোনা শেষ করে ২০০২-এর শুরু থেকে কলকাতায় বিজ্ঞাপন সংস্থায় কপিরাইটার, পরবর্তীকালে ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করেন। কলকাতা, দিল্লি, পুনে শহরে নানান বিজ্ঞাপন সংস্থায় কাজ করলেও পেশাগত জীবনের থেকে সে অধিকতর নিবিষ্ট ছিল লেখালিখিতে।
অনেক ছোটবেলাতে তার লেখালিখির শুরু। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়তে পড়তে অমিতাভ ‘শতদল’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন বন্ধু জয়দীপ নন্দীর সাথে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে এসে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় তার গল্প, কবিতা প্রকাশ পেতে শুরু করে। জলপাইগুড়ি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়ার সময় কবি ইন্দ্রনীল ঘোষ-এর মতো সহপাঠী বন্ধুদের সাথে শুরু করেন একটা পত্রিকা – ‘রুকরুকা’। ২০০০ সালে দুর্গাপুরে কবি অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়ের সাথে শুরু করেন ‘বৈখরী ভাষ্য’ পত্রিকা। কবিতা, গদ্য, গল্প, টেক্সট-এর পাশাপাশি অমিতাভ প্রহরাজ আগ্রহী ছিলেন সাইকো লিঙ্গুইস্টিক্স নিয়ে। কগনিটিভ সাইকোলজির দিকপাল, প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির প্রাক্তন অধ্যাপক, গিলবার্ট হার্মান-এর সাথে তার যোগাযোগ ছিল বলে জানা যায়।
২০২২ সালের ১০ই সেপ্টেম্বর শরীর খারাপের খবর পেয়ে হাওড়ার শিবপুরে অমিতাভ প্রহরাজের বাসার দরজা ভেঙে ঢোকে অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়। অচৈতন্য অমিতাভকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে মৃত ঘোষণা করা হয়।
প্রকাশিত বই: ‘চলো সিঙ্গলহ্যান্ড’ (বৈখরী ভাষ্য, ২০০৬), ‘অন্যব্যাপার’ (বৈখরী ভাষ্য, ২০১৩), ‘লেখামো’ (চিন্তা, ২০২২), ‘ঘুমোতে যাওয়ার আগের লেখা’ (চিন্তা, ২০২৩)।
অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়
গানের ওপারে…
উঁচু কবি। মানে লম্বা। কৈশোরে শোয়া অবস্থা থেকে বন্ধুর ডাকে এক ঝটকায় দাঁড়িয়ে পড়ে চাঁদে কাতুকুতু দিতে পারতেন। তাতে আগে চাঁদ লজ্জা পেত। এখন কবিতা হয়ে গলে পড়ে। ওঁর পা বড় বলে শুধু কলকাতায় বসে কাজ কম্মো করতে পারেন না, কাজের জন্য সারা ভারত ঘুরে বেড়াতে হয়। ফলে কবিতায় ভারতবর্ষের লম্বা ছায়া পড়ে। সবচেয়ে প্রিয় কাজ ল্যাদ খাওয়া। সেই সেরেল্যাক খাওয়ার বয়স থেকে ল্যাদ খাওয়াকে ‘রিল্যাক্স করা’ নাম দিয়েছেন। অথচ ল্যাদ যে ওঁকে গিলে খাচ্ছে সেটাও উনি বেশ বুঝতে পারেন। এই নিয়ে ভাবতে ভাবতে রিল্যাক্স করেন। যথেচ্ছ কবিতাচার করার পর একটু গলা ভেজান। যথেচ্ছ গলা ভেজানোর পর ওঁর গ্রামের বাড়ির কালিপুজোটির কথা ‘ইয়াদ’ হয়। তারপর মনের উঠোন জুড়ে জ্যোৎস্নাত আবছায়ায় গুণগুণ করে রবীন্দ্র সুরের উল বোনেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। একটা সময় কবিতা পেত ওঁর। সেই পথে একদিন মেট্রোজিলের খোঁজ করতে গিয়েই অমিতাভর সাথে বৈখরীভাষ্য। বন্ধুচূড়ামণি অনির্বাণ জমিদারি মেজাজে কবিতায় শব্দকে দিয়ে ক্যাডারের মত যা খুশি তাই করিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। কবিতা যে আদতে ওঁর ‘কলজের ব্যালকনি’ একথা উনি অক্ষরে অক্ষরে জানেন এবং প্রকাশিত দুটো বই ‘লোডশেডিং’ ও ‘রান্নাঘরে’ প্রমাণ করেও ছেড়েছেন। কবির আগামী প্রজেক্ট ‘রহস্য রোমাঞ্চ সিরিজ’। এই কবি উৎসাহী ও মনমরা। দুর্দমনীয় ও এডজাস্টিং। বাস্তববাদী ও উড়ুমন। এক কথায় এই কবি ব্যাখ্যাহীন এক সাম্রাজ্যের ঈশ্বর। তবে মাঝে মাঝে ওঁকে ফোনেও পাওয়া যায়…