thaba.in

অর্ক চট্টোপাধ্যায়ের ছোট গল্প

শেয়ার করুন

বিমোচন

 

আবার একটা আপডেট! আজকাল মাসে মাসে অ্যান্ড্রয়েড নতুন আপডেট চাইছে। কি উৎপাত রে বাবা! একটু ধাতস্থ হতে না হতে নতুন ইন্টারফেস অথবা ইন্টারফেস পুরোনো হলেও রূপান্তরজনিত কারণে ফিচারগুলোর সঙ্গে নতুন করে অভ্যস্ত হওয়া! হেরম্বকে এবার ওর বন্ধুবান্ধব অনেক করে জপিয়েছিল আইফোন নিয়ে নেবার জন্য কিন্তু ও স্যামসাঙয়ে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। স্টিভ জোবসের বায়োপিকের একটা ডায়লগ মনে আছে। ম্যাক ইজ আ ক্লোজড সিস্টেম। কেন জানি না কথাটা ক্রিপি লেগেছিল হেরম্বর। ওর ল্যাপটপ আর আইপ্যাড অলরেডি ম্যাকের তাই ফোন হয়ে গেলে নানা সুবিধা হবে। কিন্তু তাহলে যে সিস্টেমটা একেবারে ক্লোজড হয়ে যাবে। সেলফ কন্টেইন্ড সিস্টেম পছন্দ করে না হেরম্ব। ওর বরং ওপেন সিস্টেম বেশি পছন্দ। আসলে শেষ এক দশকে রোজগার বাড়লে কি হবে মধ্যবিত্ত মানসিকতা বদলায়নি। এখনো লোকাল ট্রেনে উঠলে মনে হয় এক দশকের বেশি সময় ধরে পশ্চিমবঙ্গে থাকাকালীন পড়াশোনা আর প্রাথমিক চাকরি তো ডেইলি প্যাসেঞ্জার হয়েই করেছে। সময় যত এগিয়েছে পে প্যাকেট তার শ্রেণীচরিত্র বদলে দিয়েছে কিন্তু সত্যিই কি বদলেছে হেরম্ব? এখন ব্যাঙ্গালোরে প্রবাসী, আইটি, ছকে বাঁধা ক্লিশেড জীবন। ক্লিশে শব্দে ক্লেশ শব্দের প্রেত দেখতে পায় আজকাল। আইটি হয়েছে বটে কিন্তু প্রেমটা ঠিক করা হয়ে ওঠেনি। বলা যেতে পারে সময় পায়নি প্রেম করবার। কয়েকটা হাল্কা ব্যাথা কিন্তু কোনোটাই সেরকম গড়ায়নি! বাবা মা মানিকের উপন্যাস ধরে নাম দিয়েছিল হেরম্ব। সেকেলে নাম বলে কম প্যাঁক খায়নি স্কুল-কলেজ জীবনে। ‘দিবারাত্রির কাব্য’ কোনোদিন পড়ে উঠতে পারেনি। নিজের নামের কেন্দ্রীয় চরিত্রঃ টু ক্লোজ ফর কামফর্ট! মানিক পাঠক বন্ধুরা ঠাট্টা করে বলেছে, “হেরম্বেরও প্রেম হল না, অবশ্য হয়ত হেরম্ব বলেই প্রেম হল না!” নাহ, নভেলের সামারি বা ফিল্ম কিছুই পড়েনি বা দেখেনি হেরম্ব। রাগে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্য লেখাও বিশেষ পড়েনি। আর আজকাল কাজের চাপে কিছুই প্রায় পড়ার সময় পায়না। আইটি, মাস গেলে হ্যান্ডসাম বেতন অথচ স্যামসাঙ! বন্ধু এমনকি সহকর্মীরাও আওয়াজ দেয়। কিন্তু ঐ যে বললাম, ক্লোজড সিস্টেম! হেরম্বর জীবন কি আদৌ ওপেন? সম্পর্ক না থাকলেই কি জীবনকে ওপেন বলা যায়? 

‘ইওর ফোন ইজ টেকিং আপডেট’— স্ক্রিন বলছে আধা ঘন্টা লাগবে। চার্জে বসিয়ে বারান্দায় গিয়ে একটা সিগারেট ধরায় হেরম্ব। ফ্রাইডে নাইট। সবাই যে যার মত পার্টি করতে ব্যস্ত। চল্লিশ ছুঁই ছুঁই জীবনে যৌবন নামক প্রহেলিকার সঙ্গে সহবাস শেষ হয়ে আসছে তাদের মত লোকেদের। হেরম্ব আজকাল এইসব পার্টিতে কম যায় মানে একেবারে না গেলেই নয় যখন তখনই কেবল যায়। লোকে বলে ও একা থাকতে থাকতে তাড়াতাড়ি বুড়িয়ে যাচ্ছে। হয়ত তাই কিন্তু পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেলেও ইউকএন্ডে পার্টি করতে হবে এহেন বাধ্যতামূলক আমোদকে বিষাদ মনে করে হেরম্ব। গোটা দুনিয়া যেন এক বিরাট বিষাদবাড়ি। লগহাউস যাতে আগুন ধরে সহজে! 

দাউদাউ করে কি আর সিগারেট জ্বলে? তার জন্য লগহাউস লাগে। হেরম্বর শূন্যদৃষ্টি গিয়ে পড়ল নিচের রাস্তায় যেখানে ব্যাঙ্গালোরের কুখ্যাত জ্যাম গাড়ির প্রসেশান তৈরি করেছে। এমন কত অর্থহীন মুহূর্ত সিগারেটে জ্বলে গেছে। সুরঞ্জনা, সুরঙ্গমারা বিদায় নিয়েছে। রয়ে গেছে কেবল বাটস! সিগারেটের অধোদেশ ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া গেলেও ভাষার কিন্তুকে কিন্তু সহজে দূর করা যায়নি। বারান্দা থেকে সিগারেট খেতে খেতে আর গাড়ির অসার পসরা দেখতে দেখতে হেরম্ব মাঝেমধ্যে একটা গেম খেলে। স্মার্টফোনে গাড়িগুলোর ছবি তোলে আর তারপর ফটো এডিটরে গিয়ে অবজেক্ট ইরেজার ব্যাবহার করে সেগুলো মুছে দেয়। কোনোদিন একটা গাড়ি রেখে দেয়, কোনোদিন দুটো। কবে কোন গাড়ি রাখবে আর কোন গাড়ি মুছবে সেটা ওর মর্জির ওপর নির্ভর করে। মুছে দেবার খেলাটা হেরম্বর কাছে কেবল ধবংসাত্মক নয়। বই লিখে তারপর তার পাতা উল্টে এক এক করে সব লেখা মুছে দেওয়া কি শুধু ধ্বংস? এ হল সৃষ্টি করে ধ্বংস করা। আর তাও সব কি আর ধ্বংস করে নাকি? অবশেষ রেখে দেয় একটা না একটা। সৃষ্টি আর ধ্বংসের দ্বৈরথের পর যা পড়ে থাকে তা গেমের প্রডাক্ট। এই প্রডাক্টের জন্যই তো খেলা! কোনদিন কোন গাড়িটা রয়ে যাবে সেটা ডিসাইড করতে পারলে যা মজা হয় না, মনে হয় হেরম্বই ভগবান! 

আজ ফোনটা হাতে নেই নাহলে খেলা কনটিনিউ করা যেত। তবে ব্যাঙ্গালোরের জ্যামকে ভরসা করা যায়। ফোনের আপডেট নেওয়া শেষ হতে পারে কিন্তু জ্যাম শেষ হবে না। গাড়িগুলো বদলে যাবে এই আরকি। যা বলা তাই হল। আধঘন্টা পর ফোন হাতে বারান্দায় ফিরতে হেরম্ব দেখতে পেল নিচের রাস্তায় সারিবদ্ধ গাড়ির জোনাকি এয়ারলাইন্সঃ বিষাদখিন্ন শহর ক্ষণসঙ্গমের অছিলায় নিজেই নিজের অসহায়ত্ব উদযাপন করছে। ফোনে ফটো ক্লিক করবার শব্দ শোনা গেল যদিও বারো তলার নিচের গাড়িগুলো সে শব্দ শুনতে পেল না। হেরম্ব খান তিনেক ছবি তুলে ফটো এডিটর খুলে দেখল নতুন আপডেটে অবজেক্ট ইরেজার আগের থেকে অনেক প্রিসাইস হয়ে গেছে। ব্যাকগ্রাউন্ড বেটার পিক আপ করছে, অবজেক্ট আইডেন্টিফিকেশনও ইম্প্রুভ করেছে। প্রথম ছবিতে শেষ গাড়ি, দ্বিতীয় ছবিতে মাঝের গাড়ি আর তৃতীয়তে প্রথম গাড়ি আস্তে আস্তে মুছে দিল হেরম্ব। মাঝের মানে অতগুলো গাড়ির মধ্যে কোনটা, প্রথম আর শেষটাই বা কোন ছবিতে মুছবে—এসব সিদ্ধান্ত ওর। নিজের মেজাজমর্জির রাজা হেরম্ব। এডিটেড ছবিগুলো সেভ করে ওর মনে হল গেমকে নেক্সট লেভেলে নিয়ে যাবে। সবগুলো গাড়ি ইরেজ করে দিলে কেমন হয়? আগেও একদুবার এমন চিন্তা মাথায় এসেছে, করেওছে কিন্তু আগের অবজেক্ট ইরেজার কমপ্লিট ডিলিশন নিতে পারেনি। আসলে ব্যাকগ্রাউন্ড কালার বা ডিটেইল ব্যাবহার করে অবজেক্টের শূন্যস্থান পূরণ করে ইরেজার। কিন্তু সব অবজেক্ট ইরেজ করবার ক্ষেত্রে স্ট্রং ব্যাকগ্রাউন্ড কালার বা টেক্সচার না থাকলে ছবি পিক্সেলেটেড কিম্বা হেজি হয়ে যায়। আনরিয়াল লাগে। বাস্তবতার বোধ চলে গেলে আর মজা কোথায়? তবে এই নিউ ইম্প্রুভড অবজেক্ট ইরেজার ট্রাই করা যায়। হেরম্ব একটা ছবি খুললো যেখানে মাঝের এক গাড়ি আগেই অদৃশ্য হয়ে গেছে। সেখানে পড়ে আছে এক ছটাক অন্ধকার। বাকি গাড়িগুলো সিলেক্ট করে ইরেজ করে দিতে এক অদ্ভূত আলো-আঁধার তৈরি হল শূন্যচিত্রে। পিক্সেলেটেড বা হেজি নয় কিন্তু একেবারে রিয়ালও হয়ত নয়। হেরম্বর খুবই ট্রিপি লাগলো! ঐ মুছে দেবার রঙ দেখতে দেখতে এক পেগ হুইস্কি নিয়ে বসলো। মুছে দেবারও যে রঙ হতে পারে, প্রথম অনুভব করল সে। হুইস্কির গ্লাসের খাঁজ কাটা কাঁচে না পাওয়ার রঙ ছড়িয়ে পড়ল অনেকদিন পর দেখা হওয়া বন্ধুর চওড়া হাসির মতো।   

একদিন এক সিনেমায় দেখেছিল কীভাবে অ্যাপের মাধ্যমে একটি মেয়ে তার এক্সকে তার যাবতীয় সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম থেকে ডিলিট করে দিচ্ছে। তখন থেকে অবজেক্ট ইরেজারের খেলা ওর মাথায় আসে। কিন্তু ওর এক্স ওয়াই জেড কেউ নেই। তাই গাড়ি দিয়ে খেলছে। বেশ কয়েক পেগের একাকীত্ব উদযাপনের পর হেরম্ব আবার তাকালো মুছে দেওয়া ছবির দিকে। যা দেখা যাচ্ছে তাকে ফাঁকা একফালি রাস্তা বলা যাবে না। রাস্তার উপর মুছে যাওয়া গাড়ির জায়গায় এক শান্ত অনুদ্বিগ্ন হেলো উঁকি দিচ্ছে। সেই আলো অন্ধকারের মিশেল আগুন হতে পারে, আবার জলও হতে পারে। কিন্তু হুইস্কিতে চোখ নরম হয়ে যাবার জন্য কিনা কে জানে, হেরম্ব দেখতে পেল একটি মেয়ে, মুছে যাওয়া গাড়ির জায়গায় রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে আছে, যেন ডিজিটাল আলোআঁধারি থেকে উঠে এসেছে। রাস্তাকে জ্বলন্ত লাভার স্রোত মনে হচ্ছে। জলও বটে আবার আগুনও। মেয়েটির শরীরেও জল-আগুনের যুগ্মতা। তার নাচের ভঙ্গিমা আগুন হয়ে সঞ্চারিত হচ্ছে হেরম্বর শরীরে। সে আগুনে তার শরীর জলে ভরে উঠছে, ভিজে উঠছে। অন্যদিকে ছবির ভূতুড়ে মেয়ে বহ্নিশিখা হয়ে নেচে চলেছে মুছে যাওয়া রাস্তার উপর। বেশ কিছুক্ষণ এমন নাচ চললো। রাস্তার পিছনের চিত্রাকাশে চন্দ্রোদয় দেখতে পেল হেরম্ব। তার শরীর কম্পমান। মেয়েটির শরীর যেন বিদ্যুৎ চালনা করেছে তার দেহে। রাস্তার মাঝখানের একটা স্পট প্রদক্ষিণ করতে লাগলো মেয়েটা। বেশ কয়েকবার পাক খাবার পর হেরম্বর মনে হল কেউ যেন নারীকণ্ঠে তার নাম ধরে ডাকছে। নিচু মিহি গলায় ফিসফিস করে বলছে, “হেরম্ব, আমি আনন্দ। চিনতে পারছ না আমায়? আমি তোমার আনন্দ।” কে আনন্দ? ঐ নামে কাউকে চেনে না সে। লগহাউস আগুনে পুড়ে যাচ্ছে। 

মেয়েটি যে স্পট প্রদক্ষিণ করছিল সেখান থেকে বিন্দুতে সিন্ধুর মত এক টুকরো সমুদ্র বেরিয়ে এলো আর বহ্নিমান নর্তকী প্রবেশ করলো অমোঘ অন্তিম জলাশ্রয়ে। আগুন ধুয়ে দিল জল আর মুহূর্তে অন্তর্হিত হল হেরম্বর আনন্দ। রাস্তা আবার রাস্তায় ফিরে এলো! হেরম্ব ঘড়ি দেখল। কখন যে একঘন্টা কেটে গেছে বুঝতে পারেনি। হাউ ট্রিপি! যেটা দেখল সেটা সত্যি না ওর ড্রাংকেন ফ্যান্টাসি তা হয়ত কোনোদিন জানা যাবে না। স্টিল ইমেজ যে কি করে অডিও ভিশুয়াল সিনেমা হয়ে গেল কে জানে! ছবিতে এখন কেবল মুছে দেবার রঙ। কিন্তু আনন্দ নামটা মনে বসে গেল হেরম্বর। হেরম্বর আনন্দ? যে প্রেমিকা তার বাস্তবে হয়নি? গুগলে হেরম্ব আর আনন্দ দুটো নাম একসঙ্গে দিয়ে সার্চ করলো আর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দিবারাত্রির কাব্য’ বেরিয়ে পড়ল। হেরম্ব ও আনন্দ তার দুই চরিত্র। কিছুক্ষণ দোনামোনা করে অ্যামাজন থেকে বইটা আনতে দিয়ে দিল। অবশেষে পড়বে সে তার নামের উৎসোপন্যাস। এত বছর পড়েনি, পড়তে চায়নি, কিন্তু আজ মনে হচ্ছে, পড়েই না হয় দেখুক একবার! উৎস মানে তো কেবল অতীত নয়, উৎস মানে ভবিষ্যৎও বটে। কে জানে জীবনের একলা মাঝদুপুরে এসে হয়ত এই লেখাই পথ দেখাবে তাকে, শেখাবে কি করে অ্যাপ্রোচ করতে হয় আসন্ন সন্ধ্যাকে। আফটার অল, হেরম্ব ইজ নট এ ক্লোজড সিস্টেম! হয়ত নতুন আপডেট নেবার সময় এসেছে।

অর্ক চট্টোপাধ্যায়

অর্ক চট্টোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের শূন্য দশকের কথাসাহিত্যিক। পেশায় অধ্যাপক। পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার উত্তরপাড়ার স্থায়ী বাসিন্দা। আই,আই,টি গান্ধীনগরের মানববিদ্যা বিভাগে সাহিত্য এবং দর্শন পড়ান। পেশাসূত্রে বসবাস করেন গুজরাতের গান্ধীনগরে। সম্পাদনা করেছেন ‘অ্যাশট্রে’ পত্রিকা। প্রকাশিত গ্রন্থ: ‘পিং পং গন্ধ’ (গল্প সংকলন, ২০০৯), ‘অলিখিত হ্রস্বস্বরের সন্ধানে’ (গল্প সংকলন, ২০১৫), ‘উপন্যস্ত’ (উপন্যাস, ২০১৮), ‘আতসবাজি ছায়াপথে ফিরে যাও’ (গল্প সংকলন, ২০২১)।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top