thaba.in

অমিতাভ প্রহরাজ প্রসঙ্গে অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায়

শেয়ার করুন

অসংলগ্নতা কোনো লেখা নয়।  অমিতাভ একটা অসমাপ্ত ওভার

 

অমিতাভকে নিয়ে আমার সত্যিই কিছু লেখার নেই। কিচ্ছু নেই। লেখার জন্য কিছু রেখে তো যায়নি। একটা শূন্যস্থান। কি বা লেখা যায়। কুড়ি বছর আগে জুলাই মাসে ঘোর বর্ষায় লাভা গিয়ে মাঝরাতের অন্ধকারে শুনেছিলাম উপত্যকায় মেঘ আর হাওয়া ঘুরছে। আর তার কি গর্জন। হো হো শব্দে কেঁপে যাচ্ছে চারিদিক। সে ভয়ানক। অমিতাভকে ভাবলে তেমন শব্দ হয় আমার ভেতরে। একটা শূন্যস্থানে হাওয়া ঘোরে বোধয়। এবং মেঘ। আগে ভয় হত। এখন জানি ওখানে অমিতাভই। ওই উপত্যকায়। ওটা ওর শব্দ। ওই শূন্য…ওটা ও। রাজা হয়ে আছে। মাঝে মাঝে স্বপ্নে দেখি ওকে। এমনিতে তো দেখা হয়না আমাদের। আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। কখনো যাদবপুর কফি হাউসে, কখনো বাঘা যতীন মোড়ে। কখনো বা অন্য কোনো জায়গায়। শুধু তাকিয়ে থাকে। বলেনা কিছুই। হাসে না, তোতলায় না, ফেন্ট হয়ে পড়ে যায়না, অফিস যাবার জন্য টাকা চায়না। কিছুই করে না। শুধু তাকিয়ে থাকে। এই অমিতাভকে নিয়ে কিইই বা লেখা যায়। কো্নো কমিউনিকেশ নেই। কিচ্ছু নেই, কতক্ষণ আর ওভাবে তাকিয়ে থাকা যায়? এত বছর ধরে বিজ্ঞাপনে দিস্তে দিস্তে কপি লিখেও কমিউনিকেশনটা ঠিক ম্যানেজ করতে পারলনা মাইরি। একটা ব্ল্যাঙ্ক স্পেস রেখে দিয়ে তাকিয়ে থাকে। ওকে নিয়ে লেখা যায়না। ওকে নিয়ে বলা যায়না। ওকে নিয়ে চলা…উফফ। বেঁচে থাকতে শুনেছি অনেকের কাছে। ওকে নিয়ে…মাঝে মাঝে ফোন আসত আমার কাছে। আমাদের সবার কাছেই এসেছে বোধয়। অমিতাভদা এই করেছে…বলো কেন করবে…? অমিতাভ এটা কেন করল? সেটা কেন করল? আমার সাথেই কেন করবে? আজকাল আর অমিতাভ কিছুই করেনা। শুধু তাকিয়ে থাকে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে রোদ কড়া হয়, ঢলেও পড়ে পশ্চিমে। কিন্তু কিচ্ছু করেনা। আমার খুব কিছু বলার নেই।  

বন্ধু মরে গেলে কিভাবে রিয়াক্ট করতে হয় জানতাম না। অনির্বাণের মুখ মনে পড়ে। হাওড়া হাসপাতালে রাত নটা বা সাড়ে আটটা। ওকে দেখতে পেলাম না। বডি নিয়ে চলে গেছে। ওকে নিয়ে সারাদিনের দৌড় দৌড়িতে ক্লান্ত অনির মুখ। বলল ‘মর্গে নিয়ে চলে গেছে’। বলল ‘বাঁচাতে পারলাম না রে…’। আমি বোধয় অনির হাতটা ধরেছিলাম। কাঁদা উচিত ছিল? কষ্ট দলা পাকিয়ে গলার কাছে আটকে যাবার কথা ছিল? জানিনা। বুঝতেই পারিনি শালা যে অমিতাভ আর নেই। বন্ধু মরে গেলে কিরম হয়? আজও কি বুঝি? অমিতাভ যখন আমার দিকে তাকিয়ে থাকে বুঝতে পারি কি ও মরে গেছে? বুঝতে পারি কি ও আর লম্বা রান আপে বোলিং করবে না?

অমিতাভ লম্বা রান আপে বল করতে বড় ভালবাসত। ব্যাট ফ্যাট করা ওর পোষাত না। যেখান থেকে দৌড় শুরু করত, হয়তো বোলারকে ব্যাটার দেখতেই পাচ্ছে না। রান আপ এত লম্বা যে ব্যাটার স্টান্স নেওয়ার বদলে মাঝে মাঝে উইকেট কিপারের সাথে গল্প কর‍ত। বলত আসুক আসুক… এইভাবে তিন চারটে বল করার পরই ওভার শেষ ঘোষণা করতে হত। কারণ অমিতাভ এত হাঁপিয়ে যেত যে আম্পায়ারের ওভার শেষ…ঘোষণা করা ছাড়া কোনো উপায় থাকত না। এসব ঘটেছে বাঘাযতীনে আমাদের মেসের গলিতেই। পূর্ণিমার জ্যোৎস্নাকে  আমরা ফ্লাড লাইট মেনে যখন ক্রিকেট খেলতাম তখন। 

আমাদের মেস এমনিতেই বেশ সরগরম থাকত সবসময়। এটা ওটা সেটা। এ ও সে। অনেক মানুষজন থাকত। অনেক মানুষজন আসত যেত। বন্ধু বান্ধবরা তো ছিলই। মেসের বাকি বোর্ডাররা এবং ছিলাম আমরা। বৈখরী। সারাদিন পড়াশোনা আর কাজকম্মো নিয়ে কাটত আর রাতে ফিরে এসে কবিতা। আড্ডা এবং কবিতা পড়া ছিল আমাদের রোজের কাজ। তো সেখানে অমিতাভর কবিতা শুনে বিস্মিত হতাম। রোজ। ওর শব্দ গঠন, ওর ভাবনার ব্যবহার, ওর দৃষ্টিভঙ্গি। আড্ডার ‘বাহ বাহ’ পেরিয়ে সেগুলো মনের মধ্যে থেকে যেত অনেকদিন। মানে অনেক মাস। অনেক বছর। আর অমিতাভ সেইসব মুগ্ধতার সুযোগ বেশ ভালরকমই নিত। লেখা শোনালে বলত লেখায় এটা কর ওটা কর। চেঞ্জ কর। মুগ্ধ ছিলাম বলেই  হয়ত, আমি আর নিজেকে এক্সপ্লেন করার চান্সগুলো বা ঝগড়া করার চান্সগুলো নিতে পারতাম না। আর সেই সুযোগে অমিতাভ আরো জ্ঞান দিত। ফলে প্রথমদিকে তেমন বন্ধুত্বের ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠার থেকেও ব্যাপারটা গুরু শিশ্যের সম্পর্কের দিকেই প্রায় চলে যাচ্ছিল। লেখার কথা উঠলেই নানান জ্ঞানগম্যি। কিছু বলাও যেতনা । কবিতার রাজামশাই বলছেন…কিন্তু আমি বরাবরই খুব এডামেন্ট ছিলাম। একগুঁয়ে। শুনি সবার, করি নিজের। আমার লেখায় আমি কারোর কোনো প্রভাব আমি রাখতে চাইনি কোনোদিন। সচেতনভাবে। ফলে আমার লেখা অনেকেরই না পসন্দ। তখনো ছিল। এখনো তাই । তো মুগ্ধ হওয়াটা মুগ্ধ হওয়ার জায়গাতেই রইল। আমি লিখলাম অন্যকিছু। সচেতনভাবেই। ফলে অমিতাভর সঙ্গে আমার গুরু- শিস্যর বন্ডিংটা আর টিকল না। কোলের ছেলে কুলাঙ্গার হয়ে গেলে বলে অমিতাভর সাময়িক সেটব্যাক তো হলই। কিন্তু সেটা ততটাও বড় হয়ে দেখা দেয়নি কারণ আরেক কোলের ছেলে সুপ্রতীমকে মানুষ করার জন্য অমিতাভ তখন মন প্রাণ ঢেলে দিল। সেই রিলেশানটা ‘গুরু-শিস্য; পরম্পরা ছাপিয়ে ‘ভক্ত-ভগবান’ পর্যায়ে যখন চলে গেল, তখন একদিন রাতে বাঘাযতীন মোড়ে প্রকৃত বা অপ্রকৃত অমিতাভ কি করে জানিনা, সুপ্রতীমকে চিনতে অব্দি ইনকার করে অন্য রাস্তা দিয়ে হন হন করে হেঁটে যখন অন্য দিকে চলে গেল, সুপ্রতীম কান্নায় ভেঙে পড়ল। ভক্ত-ভগবানের সম্পর্কের সেই যে ব্রেকাপ হল তা আর কখনো জুড়ল না। আমি বড় বাঁচা বেঁচে গিয়েছিলাম, তাই শেষদিন অব্দি অমিতাভর সঙ্গে আমার বন্ধুত্বটা টিকে গিয়েছিল।  

অমিতাভ কবিতা লিখতে লিখতে দুলত। পড়তে পড়তেও দুলত। নিশ্চিত ছোটবেলায় দুলে দুলে পড়া মুখস্থ করত। কথা বলতে গিয়ে আটকাতো, আর গাবদা গাবদা পেন দিয়ে গোটা গোটা অক্ষরে কবিতা লিখত। ওর রফলা দেওয়ার সময় মনোযোগ দেখে আমি অবাক হয়ে যেতাম। ‘প্রহরাজ’ যখন লিখত তখন ‘প্’এ’ ‘র’ ফলা দেওয়ার পর্বটা দেখার মতো একটা বিষয়। যারা ওর নামলেখা দেখেছে, সবাই লক্ষ্য করলে দেখবে অমিতাভর সবচেয়ে যত্নে লেখা অক্ষর দুটো হল ‘অ’ আর ‘প্র’। প্রথম অক্ষর দুটো। অমিতাভ কবিতা লিখত বড় বড় ফুলস্কেপ সাদা খাতায়। পরে ওর এই প্রভাব আমার ওপরে পড়েছিল। আমি ওর থেকে দেখেই কবিতা লেখায় সাদা ফুলস্কেপ খাতা ব্যবহার করা শুরু করি, যা এখনো বজায় আছে। ও যখন হাতে বালা পড়ে কব্জি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে লিখত মনে হত সাদা খাতা কোনো এক ব্যায়ামাগার। ব্যায়াম করছে। অতটা না হলেও আমারো মাঝে মাঝে হয় লেখা একটা ফিজিক্যাল কাজতো বটেই। লম্বা রানাপের পেসার ছিল তো কাজকর্ম একটু ফিজিক্যাল তো হবেই। 

চিত্তরঞ্জন কলোনী। ওপাড়ায় অনেক মেস। একটা বড় মাঠ, মাঠের পাশে ইস্কুল, তার ওদিকে কয়েকটা মুদির দোকান, এদিকে ক্লাবের লাইব্রেরি। আর লাইব্রেরির পর থেকেই শুরু থোকা থোকা মেসবাড়ি। অমুক মেস, তমুক মেস। তো আমরা বেশ খানিকটা ঢুকে এসে থাকতাম। চিনির মেস। গ্রিল, ঘুলঘুলি, ঈয়াবড় সবুজ ডায়াল টেলিফোন, লম্বা প্যাসেজ, ভাঙাচোরা ব্যাকিয়াড নিয়ে চিনির মেস। আর ওই একটা খিড়কি দুয়ার।  খিড়কি দুয়ার। দরজাটা ছিল পুরোনো এবং অনেক আগে রং করা। কোনো হালকা রং ছিল সম্ভবত। কিন্তু সেটা আর বোঝা যেত না। তবে খুব নোংরা ছিল না। ছিল মলিন। কিন্তু বেশ শক্ত পোক্ত। আমরা ঠেস দিয়ে কবিতা পড়তাম। ঠেস দিয়ে তর্ক করতাম। ঠেস দিয়ে ঠেস দিতাম। আই মিন, কারোর পেছনে লাগতাম। কিন্তু কখনো দিনের বেলা দরজাটা খুলতাম না। খুলতাম রাতে, অমিতাভ এলে অথবা রাত দেড়টার সময় চা খেতে যাবার সময়। যখন বিশ্ব ঘুমোচ্ছে, আর মেন গেইট বন্ধ। বাইরে যাওয়ার কোনো রাস্তাই খোলা নেই তখন। ওই খিড়কি দুয়ার দিয়েই চা খেতে যাওয়া হত বাঘাযতীন মোড়ে। সবাই। রোজ অবশ্য অমিতাভ আসত তেমন না, তবে মাঝে মাঝে আসতই। এসে চাপা গলায় ডাকত অনির্বাণকে… 

ওই মেসবাড়িটাতেই ওর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। সেটাও একটা রাত। কলকাতা শহরে থাকার জায়গা খুঁজতে গেছি, একটা টিউব জ্বলা ঘরে, চৌকিতে বসে কবিতা পড়ছিল ও। আর আমরা শুনছিলাম নীচে বসে। সেদিন থেকেই গিয়েছিলাম। আমরা মানে আমি আর সুপ্রতীম। মেসে থাকতে তখনো শুরু করিনি। সেদিন মধ্যরাত অব্দি চলেছিল অমিতাভ প্রহরাজের কবিতা পাঠ। সেই মেসবাড়ি। যেখানে আমাদের কলকাত্তাইয়া হয়ে ওঠা। যেখানে বৈখরী পত্রিকার সাবালক হয়ে ওঠা। আধো অন্ধকার সেই মেসবাড়ি। 

একটা তুমুল ছায়াচ্ছন ঘর ছিল একমেব্দ্বিতীয়ম অমিতাভর রাজপাট। যাকে সবাই বেবি বলত। আমি অমিতাভই বলেছি। আগে অমিতাভ+দা বলতাম তারপর কালের নিয়মেই ‘দা’ টা খসে গিয়েছিল। 

মেস থেকে বেরবার পর অমিতাভ বাড়ি বদল করত ঘন ঘন। কখন শুনলাম পল্লীশ্রীতে আছে, কখন বিজয়গড়, কখনোবা সোনারপুর। ফুল গেছো দাদা। একদিন রাতে বাঘাযতীনে গিয়ে দেখি এক রিকশাওয়ালাকে ধরে বসিয়ে কবিতা শোনাচ্ছে। সেও শুনছে। এরম নাকি প্রায়ই শোনে। আর ও শোনায়ও। তারপর ফাস্ট ট্রেনে বাড়ি যায়। শোনানো শেষ হলে বলি ‘কিরে?’ ও হাসে। ভুবন মোহিনী হাসিটা। তারপর হইহই করে চা খায় আমাদের সাথে। বললাম এখন কোথায় আছিস? বলল ‘বিজয়গড়। এখান থেকে কাছেই। চলে আয় একদিন।‘ ‘হ্যাঁ যাব’ চা খেয়ে বাবু রিক্সা করে রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। আমি বললাম ‘রিক্সা?’ কে যেন একটা বলল ‘মাইনে পেয়েছে…’

মাইনে তো অমিতাভ কতই পেয়েছে। আমাদের ওই খিড়কি দুয়ারের পাশেই রাখা থাকত ওলিভ সবুজ টেলিফোনটা। বাড়ি থেকে বাড়িওয়ালার কাছে ফোন এলে ওখানে ট্রান্সফার করা হত। আর বিশেষ কোনো কাজ ছিল না ফোনটার। শুধু মাসে একদিন বাদ দিয়ে। অমিতাভ যেদিন মাইনে পেত। মাইনে পেলেই গলাটা অমিতাভ বচ্চনের মত করে ফোন করত অফিস থেকে। করে বলত ‘ছটায় অলি’ এবার যে সেই ফোন রিসিভ করত তার দায়িত্ব থাকত সবাইকে নিয়ে বিকেল ছটায় অলিপাবে উপস্থিত থাকা। তারপর অমিতাভ আমাদের নিয়ে মদ্যপান করতে বসত। সেদিন সব খরচা অমিতাভর। তারপর হইহই করে ট্যাক্সি করে মেসে ফেরা।

গভীর কোনো বর্ষার দিন বা বিষাদগ্রস্থ হাইওয়ে রাইড ছাড়া এসব কথা আজকাল আর মনে পড়ে না। মনে হয় আগের জন্মের কথা। কিন্তু অমিতাভ সত্যিই একটা অধ্যায়। আমার জন্য। আমাদের জন্য। ওকে নিয়ে খুব কিছু বলতেও ভাল লাগে না। মনে হয় অনেককিছু অসমাপ্ত রেখে ও চলে গেল। ওর মৃত্যুর পরও আমার মনে হয়নি ও চলে গিয়েছে। শিবপুর শ্মশানে যখন ওর বডি শোয়ানো,  চুল্লির জন্য অপেক্ষা করছি আমরা, তখনো মনে হয়েছিল চকরা বকরা জ্যাকেটটা গায়ে দিয়ে ঢোকার রাস্তাটা দিয়ে ঢুকে আসবে আর বলবে…’যাহ ** মরে গেছি?’ আমি অনেকবার বাঁ দিকে ঢোকার রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে দেখছিলাম। কিন্তু ও আর এলনা। তারপর চুল্লি। তারপর বাইরে গিয়ে যখন দেখলাম চিমনি দিয়ে ধোঁয়া হয়ে বেরিয়ে অমিতাভ আকাশে মিলিয়ে যাচ্ছে, পাশের গঙ্গার হাওয়ায় ধোঁয়াটা হালকা কেঁপে যাচ্ছে তখনো ভাবছি ‘সত্যি কি চলে যাচ্ছে? ‘ অনেককিছু বাকি রয়ে গেল রে অমিতাভ…অনেক গল্প, অনেক বাওয়াল, অনেক কবিতা… লম্বা রানআপ নিয়ে এত ক্লান্ত হয়ে পড়লি যে ওভারটা অব্দি শেষ করে যেতে পারলি নারে। এত লম্বা রানআপ কেউ নেয়? 

অমিতাভ প্রহরাজ

১৯৭৯ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি পূর্ব মেদিনীপুরের পানিপারুল গ্রামে জন্ম। স্কুলে ভর্তি হওয়ার সময় বয়স কম হয়ে যাচ্ছিল বলে সার্টিফিকেটে জন্ম তারিখ ১৪ই ফেব্রুয়ারি। সেই থেকে অমিতাভ’র ভ্যালেন্টাইন ডে শুরু। বাবার কর্মসূত্রে তিন/চার বছর বয়সে দুর্গাপুরে চলে আসা।সেখানেই মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক। ১৯৯৭ সালে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে জলপাইগুড়ি গভর্নমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। ২০০১ সালে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ স্নাতক অমিতাভ বিজ্ঞাপন নিয়ে স্নাতকোত্তর পড়তে আহমেদাবাদে Mudra Institute of Communications (MICA)-এ যান। বিজ্ঞাপন নিয়ে পড়াশোনা শেষ করে ২০০২-এর শুরু থেকে কলকাতায় বিজ্ঞাপন সংস্থায় কপিরাইটার, পরবর্তীকালে ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করেন। কলকাতা, দিল্লি, পুনে শহরে নানান বিজ্ঞাপন সংস্থায় কাজ করলেও পেশাগত জীবনের থেকে সে অধিকতর নিবিষ্ট ছিল লেখালিখিতে। 

অনেক ছোটবেলাতে তার লেখালিখির শুরু। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়তে পড়তে অমিতাভ ‘শতদল’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন বন্ধু জয়দীপ নন্দীর সাথে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে এসে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় তার গল্প, কবিতা প্রকাশ পেতে শুরু করে। জলপাইগুড়ি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়ার সময় কবি ইন্দ্রনীল ঘোষ-এর মতো সহপাঠী বন্ধুদের সাথে শুরু করেন একটা পত্রিকা – ‘রুকরুকা’। ২০০০ সালে দুর্গাপুরে কবি অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়ের সাথে শুরু করেন ‘বৈখরী ভাষ্য’ পত্রিকা। কবিতা, গদ্য, গল্প, টেক্সট-এর পাশাপাশি অমিতাভ প্রহরাজ আগ্রহী ছিলেন সাইকো লিঙ্গুইস্টিক্স নিয়ে। কগনিটিভ সাইকোলজির দিকপাল, প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির প্রাক্তন অধ্যাপক, গিলবার্ট হার্মান-এর সাথে তার যোগাযোগ ছিল বলে জানা যায়।

২০২২ সালের ১০ই সেপ্টেম্বর শরীর খারাপের খবর পেয়ে হাওড়ার শিবপুরে অমিতাভ প্রহরাজের বাসার দরজা ভেঙে ঢোকে অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়। অচৈতন্য অমিতাভকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে মৃত ঘোষণা করা হয়।  

প্রকাশিত বই: ‘চলো সিঙ্গলহ্যান্ড’ (বৈখরী ভাষ্য, ২০০৬), ‘অন্যব্যাপার’ (বৈখরী ভাষ্য, ২০১৩), ‘লেখামো’ (চিন্তা, ২০২২), ‘ঘুমোতে যাওয়ার আগের লেখা’ (চিন্তা, ২০২৩)।

অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায়

গল্প হলেও সত্যি
শুকনো ডাঙার কবি। নেশা ছাড়া জলে খুব একটা নামেন না। জিরাফ খুব পছন্দের animal। ধর্মে ও জিরাফে দু’জায়গায়তেই থাকার লোভ প্রচন্ড, কিন্তু খুব একটা তাল রাখতে পারেন না। মাসাইমারায় বসে ভুট্টা খাওয়াই শ্রেষ্ঠ রোমান্টিসিজম মনে করেন কবি। কবিতা কী ও কেন এই প্রশ্নে সজাগ, কিন্তু নিরুত্তর। তবে একমাত্র  কবিতা লেখার উদগ্র লোভই তাঁকে দিয়ে গত দু’দশকে অনেক কবিতা লিখিয়ে নিয়েছে। রোববারে খাসির ‘বোন ম্যারো’ খাওয়ার মতো করেই জীবনের নানা রূপ- রস-গন্ধ চুষে কবিতা বার করেন। কিন্তু খাসির এত দাম বেড়ে গিয়েছে যে শেষ কোন রোববার খাসি খেয়েছেন ভুলে গিয়েছেন। ফলে সেই প্র্যাকটিসে ভাটা পড়েছে। এমনিতে কবিতা লেখেন নাকি কবিতা করেন এই দ্বিধায় দীর্ঘদিন ভুগেছেন। কারন ওঁর নাকি কবিতা ‘পায়’। তো সেই সমস্যা সদ্য সমাধান হয়েছে। এখন উনি কবিতা খুব একটা না লিখলেও, পুরোনো একটা কবিতা খুলে এডিট করে  চার পাঁচটা কবিতা বানিয়ে ফেলতে খুব পছন্দ করেন। কবিতা নিয়ে উনি ‘ইগোবায়ুগ্রস্থ’ নন। অর্থাৎ কবিতা নিয়ে ওঁর কোনও ‘ওসিডি’ নেই। তাই নিজেই অবাক হয়ে নিজেকে বাঙালি কবি নয় বলে সন্দেহ করেন এবং ‘সাউথ ইন্ডিয়ান বাংলা কবি’ বলে বিশ্বাস করেন। সেইমতো একটা কড়া গোঁফও নাকের ডগায় ঝুলিয়ে রাখেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top